দিনভর ছাত্র বিক্ষোভ, সংঘর্ষ
গতকাল বুধবার ছুটির দিনেও ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিনমিছিল এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মুখে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কফিনমিছিল পণ্ড হয়ে যায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল বন্ধের ঘোষণা ও পুলিশের তৎপরতার মুখে অনেক শিক্ষার্থী সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। তবে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অনেক ছাত্রছাত্রী হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন।
এর আগে হল ত্যাগের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও ছাত্র হত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের কর্মসূচিতে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও দিনভর বিক্ষোভ ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সকাল থেকে আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামলে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ-বিজিবি-র্যাব ও সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ আজ বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ) পালন করবেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এই কর্মসূচি চলাকালে শুধু হাসপাতাল, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।
গতকাল রাত আটটার দিকে ফেসবুকে কর্মসূচির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। সারা দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই লড়াইটা শুধু ছাত্রদের নয়, দলমত-নির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারণের।
কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম প্রথম আলোকে বলেন, কমপ্লিট শাটডাউন বলতে তাঁরা ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ বুঝিয়েছেন।
দিনভর উত্তাপ
গতকাল দিনভর উত্তপ্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে মোড়ে মোড়ে অবস্থান ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। দুপুর থেকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির বিপুলসংখ্যক সদস্য সাঁজোয়া যান নিয়ে ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত কফিনমিছিল শুরু করা মাত্র হামলা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় দুই পাশ থেকে সম্মিলিত আক্রমণের মধ্যে পড়ে আহত হন কয়েকজন নারীসহ অন্তত ২০ শিক্ষার্থী। আহত হয়েছেন ১০ জন সাংবাদিকও। এর বাইরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে হামলায় আহত হয়ে গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন আরও ৩৫ জন।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিনেও রাজধানীসহ দেশের অন্তত ১০টি জেলায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া অন্তত ১০টি জায়গায় সড়ক ও মহাসড়ক এবং দুই জায়গায় রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনকারীরা।
কফিনমিছিলে সাউন্ড গ্রেনেড হামলা
ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে আন্দোলনকারীদের ক্যাম্পাস ছাড়া করতে টানা অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুপুরের পর তাদের টানা দুই ঘণ্টার অভিযানে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সেখানেও দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।
পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকাল বেলা দুইটায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘গায়েবানা জানাজা ও কফিনমিছিল’ কর্মসূচি ছিল আন্দোলনকারীদের। কিন্তু পুলিশের বাধায় সেখানে গায়েবানা জানাজা হয়নি। পরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে ক্যাম্পাসে কফিন নিয়ে মিছিল শুরু করলে একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা আবার সূর্য সেন হলের সামনে জড়ো হন।
এরপর ঘণ্টাখানেক পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ চলে। পুলিশ সদস্যরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। অপরদিকে শিক্ষার্থীরা মাস্টারদা সূর্য সেন হলের সামনে অবস্থান নেন। পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের জবাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন তাঁরা। পুলিশের সঙ্গে টিকতে না পেরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ওই এলাকার হলগুলোর ভেতরে চলে যান শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সূর্য সেন হলের সামনে এসে অবস্থান নেয় পুলিশ। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল হক সেখানে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ বন্ধ করে পুলিশ।
এরপর হলগুলো থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত মোড়ের দিকে চলে যান। সেখানে তাঁরা অবস্থান নিলে পুলিশ আবারও তাঁদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। জবাবে শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। আধা ঘণ্টা পর সেখান থেকে চলে যান শিক্ষার্থীরা। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান নেন।
বিকেলে শিক্ষার্থীদের মিছিলে কেন হামলা চালানো হলো, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্যের বাসভবন ও আশপাশের এলাকার নিরাপত্তার স্বার্থে উপাচার্যের অনুমতিক্রমে মিছিল ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, গায়েবানা জানাজা শেষে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল শুরু করলে পুলিশ নির্বিচার হামলা চালায়।
রাতে আবার সংঘর্ষ
রাত পৌনে ১০টার দিকে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের আরেক দফা পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের সামনে থেকে ঘটনার শুরু। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চানখাঁরপুল মোড় পর্যন্ত দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। প্রায় আধা ঘণ্টা সংঘর্ষ চলার পর আন্দোলনকারীরা পুরান ঢাকার দিকে চলে যান।
হামলার পরও ক্যাম্পাসে অনেকে
পুলিশের হামলার মুখে সন্ধ্যার দিকে আন্দোলনকারী অনেক শিক্ষার্থী হল ছেড়ে যান। এ সময় শাহবাগ এলাকা দিয়ে বের হওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর ও হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও জনতার ব্যানারে গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। জানাজার পর ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে অবস্থান নেন।
শিক্ষার্থীরা শাহবাগ দিয়ে বের হওয়ার সময় তাঁদের মুঠোফোন তল্লাশি এবং মারধর করতে দেখা গেছে। বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে অন্তত তিনজনকে মারধর করা হয়। তাঁদের দুজনকে পুলিশ রক্ষা করে। একজন দৌড়ে শাহবাগ থানায় ঢুকে পড়েন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ছাত্রী হলের অনেক শিক্ষার্থী গতকাল রাতে হলে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা জানান, হামলাকারীদের বিচার না করে তাঁরা হল ছেড়ে যাবেন না।
দুই শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনেন শিক্ষকেরা
শাহবাগ থানায় পুলিশের হাতে আটক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে নিলেন শিক্ষকেরা। বেলা একটার দিকে শিক্ষকদের একটি দল মৌন মিছিল নিয়ে থানায় গিয়ে তাঁদের ছাড়িয়ে নেয়। এরপর অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ করেন শিক্ষকেরা।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী বলেন, থানায় দুই ছাত্রকে আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে একজনের কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক একটি ভিডিও নেওয়া হয়েছে এই বলে যে সে সরকার পতনের আন্দোলনে ছিল। এ ধরনের নিপীড়ন-অত্যাচার চলছে।
শনির আখড়ায় দিনভর সংঘর্ষ
রাজধানীর শনির আখড়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক গতকাল দিনভর অবরোধ করে রাখার পর সন্ধ্যায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এ সময় দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। সর্বশেষ রাত ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলছিল। শনির আখড়ার কাজলায় হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যাত্রাবাড়ী থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত পুরো এলাকা ছিল বিক্ষোভকারীদের দখলে। সেখানে র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যের অবস্থান ছিল। এতে ফ্লাইওভারের শনির আখড়া অংশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সন্ধ্যায় সেখানে সংঘর্ষের সময় পুলিশের শটগানের গুলিতে আহত ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে জানান ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই বছরের একটি শিশুও রয়েছে।