নগর কর্তৃপক্ষের তখনকার নাম ছিল ‘চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি’। চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টি এম কির্কউড তখন পদাধিকার বলে মিউনিসিপ্যালিটিরও চেয়ারম্যান। ১৮৭৫ সালে কির্কউড মিউনিসিপ্যালিটিতে ‘পাবলিক ল্যাট্রিন’ বা গণশৌচাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু শহরের মানুষ তাঁর এই উদ্যোগ মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামেন, এমনকি মিউনিসিপ্যাল অফিস পর্যন্ত ঘেরাও করেন। কির্কউডও তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদেরই জয় হয়।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরামর্শক ও লেখক হারুন রশীদের ‘উপনিবেশ চট্টগ্রাম: ৫০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস’ নামের বইয়ে এই আন্দোলনের বিবরণ পাওয়া যায়। মিউনিসিপ্যালিটি চেয়ারম্যান কির্কউড সম্পর্কে এই বইয়ে বলা হয়, তিনি নানা উদ্ভট কীর্তির জন্য উনিশ শতকের চট্টগ্রামবাসীর কাছে পরিচিত ছিলেন।
কির্কউডের উদ্যোগটির সরস বর্ণনা দিয়েছেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। তিনি তখন চট্টগ্রাম কমিশনারের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। কমল চৌধুরী সম্পাদিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ বইয়ে নবীনচন্দ্র সেনের ‘চট্টগ্রাম স্মৃতি’ নামে একটি লেখা ছাপা হয়। এই লেখায় তিনি আন্দোলনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি তাঁর লেখায় মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের নাম সরাসরি উল্লেখ করেননি। তাঁকে তিনি ‘কালকূট’ নামে আখ্যায়িত করেন।
নবীনচন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘কালকূটের আকাঙ্ক্ষা হইয়াছিল যে তিনি চট্টগ্রামে একটি চিরস্মরণীয় কীর্তি রাখিয়া যান এবং কীর্তিধ্বজা স্থির করিয়াছিলেন—সাধারণ পায়খানা (পাবলিক ল্যাট্রিন)! তাহার যুক্তি অকাট্য। বিলাতে যদি সাধারণ আহারের স্থান হইতে পারে, তবে ভারতে সাধারণ পায়খানা হইতে পারিবে না কেন? তাহার স্থির সঙ্কল্প যে সাধারণ পায়খানা নির্মাণ করিয়া, তিনি দরিদ্র নগরবাসী নরনারী সকলকে তাহাতে যাইতে পুলিসের দ্বারা বাধ্য করিবেন।’
কির্কউডের উদ্যোগে শহরে শোরগোল পড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে নবীনচন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘এই লোকটির (কির্কউড) কি রাশি ছিল, জানি না। কিন্তু লোকটি ভালো কার্য্য করিতে গেলেও, এমনভাবে করিত যে, দেশশুদ্ধ লোক বিগড়াইয়া যাইত।...সাধারণ পায়খানায় নরনারীগণকে জোর করিয়া লইবে, এ সংবাদে একটা হুলস্থূল পড়িয়া গেল।’
চট্টগ্রামে তখন শৌচাগারের ভালো ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কির্কউডের উদ্যোগের বিরুদ্ধে শহরবাসীর আন্দোলনে নামার কারণ উল্লেখ করেছেন নবীনচন্দ্র সেন। তাঁর ভাষ্য, ‘সে সময় চট্টগ্রাম শহরের ওপর অধিকাংশ দরিদ্র মুসলমানের ভদ্রাসন বাড়ি। হিন্দুদের বাসা বাড়ি মাত্র। তাহাদের ভদ্রাসন বাটী পল্লীগ্রামে। তখন পৈতৃক বাসস্থান ছাড়িয়া শহরে বাড়ি করা কি হিন্দু, কি মুসলমান, ভদ্রলোকের পক্ষে নিন্দনীয় বিষয় ছিল।...মুসলমান দরিদ্র হইলেও তাহার পর্দা চাই। অনেকে শুনিয়াছি, আপনার স্ত্রীর স্নানের জল পর্যন্ত বহন করে, তথাপি স্ত্রীকে গ্রামের পুষ্করিণীতে পর্যন্ত যাইতে দেয় না। অতএব এই মুসলমান স্ত্রীলোকদের প্রকাশ্য স্থানে, প্রকাশ্য পায়খানায় যাইতে হইবে, ইহার অপেক্ষা ঘোরতর বিপ্লবের বিষয় আর কী হইতে পারে?’
নবীনচন্দ্র সেনের লেখা থেকে জানা যায়, দু-একজন ছাড়া মিউনিসিপ্যালিটির সব কমিশনার এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন। শহরের শত শত মানুষ মিউনিসিপ্যাল অফিস ঘেরাও করেছিলেন। মানুষের আন্দোলনে প্রকম্পিত হয়েছিল শহর। কিন্তু এই আন্দোলনে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেননি কির্কউড। তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্থির ছিলেন। তিনি শহরের চার জায়গায় চারটি শৌচাগার প্রস্তুত করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের কমিশনার লাউইসের কাছে আবেদন করেছিলেন আন্দোলনকারীরা। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা চারটির মধ্যে তিনটি গণশৌচাগারই জ্বালিয়ে দেন। কির্কউড ক্ষেপে গিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা জমিদার লালচাঁদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন। তবে আইনি লড়াইয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি পান লালচাঁদ। পরবর্তী সময়ে নবীনচন্দ্র সেন ও আইনজীবী মনোমোহন ঘোষ সরকারের কাছে একটি ‘মেমোরিয়েল’ (দরখাস্ত) পাঠান। এই দরখাস্তের পরিপ্রেক্ষিতে কির্কউডকে তীব্রভাবে তিরস্কৃত করে সরকার। একই সঙ্গে তাঁর পদাবনতি হয়।
চট্টগ্রামের ইতিহাস-বিষয়ক গবেষক জামাল উদ্দিন দেড় শ বছর আগে হওয়া এই আন্দোলনের সঙ্গে এখনকার আন্দোলনের একটি মিল খুঁজে পাচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুটি ক্ষেত্রেই নগরবাসীর মতামত না নিয়ে তাঁদের ওপর একটি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে নগর কর্তৃপক্ষ। মানুষ এখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। ঠিক এই মুহূর্তে নগরবাসীর ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই নাগরবাসী নিরুপায় হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন।