যে কারণে সাত আসামির আমৃত্যু কারাদণ্ড

হাইকোর্ট ভবন
ফাইল ছবি

রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে সাত বছর আগে জঙ্গি হামলা ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় করা মামলায় নব্য জেএমবির সাত সদস্যকে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ মামলায় বিচারিক আদালতের চার বছর আগে দেওয়া রায়ে সাত আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল।

বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার ওই রায় দেন। ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) নামঞ্জুর করে আসামিদের আপিল ও জেল আপিল খারিজ করে এই রায় দেওয়া হয়।

আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাত আসামি হলেন রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালেদ। আসামিরা কারাগারে রয়েছেন।

রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারা অনুসারে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণের দায়ে বিচারিক আদালত সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। তবে আসামিরা আইনের ৬(১)(ক)(আ) ধারার অপরাধ করেছেন অর্থাৎ কেউ সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। তবে তারা ষড়যন্ত্র, সহায়তা ও প্ররোচনায় সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড হলেও সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন দেওয়ার কথা আইনের রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ‘আতাউর মৃধা ওরফে আতাউর বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের ১৭৯ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ অনুসারে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় হাইকোর্ট সাত আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে এবং কুপিয়ে ও গুলি করে ২২ জনকে হত্যা করে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ইতালির নাগরিক নয়জন, জাপানের সাতজন, ভারতের একজন ও বাংলাদেশি তিনজন। আর সেই রাতে জিম্মিদের মুক্ত করতে অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের বোমা হামলায় নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। এ ঘটনায় করা মামলায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালত রায় দেন। রায়ে নব্য জেএমবির উল্লিখিত সাত সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।

বিচারিক আদালত কোনো আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। নিয়ম হলো বিচারিক আদালতে কোনো মামলার রায়ের পর মামলাসংক্রান্ত সব কাগজপত্র ২০১৯ সালে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৌঁছে, যা একই বছর ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নিবন্ধিত হয়। ডেথরেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) প্রস্তুত করতে হয়। ডেথ রেফারেন্সের শুনানির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। অন্যদিকে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা পৃথক আপিল ও জেল আপিল করেন। ডেথরেফারেন্স, আসামিদের আপিল ও জেল আপিলের ওপর একসঙ্গে ১১ অক্টোবর শুনানি শেষ হয়। সেদিন আদালত রায়ের জন্য ৩০ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। এ অনুসারে ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল ও জেল আপিল রায়ের জন্য আজ আদালতের কার্যতালিকায় এক নম্বর ক্রমিকে ছিল।

যে কারণে আমৃত্যু কারাদণ্ড
আসন গ্রহণের পর ক্রম অনুসারে বিষয়টি উঠলে বেলা ১১টা ২৫ মিনিটের দিকে বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি সহিদুল করিম বলেন, ‘আমার ব্রাদার (দ্বৈত বেঞ্চের অপর বিচারপতি) রায় দেবেন। আইনজীবীদের সাবমিশনসহ সংক্ষিপ্ত আকারে দেবেন। বিস্তারিত পরে দেওয়া হবে। এরপর বাংলায় রায় ঘোষণা শুরু করেন বেঞ্চের অপর বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান। চলে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গি অভিযানে নিহত হন। তাঁরা হলেন রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।

নথিপত্র পর্যালোচনা করে রায়ে আদালত বলেন, এটি স্বীকৃত যে আপিলকারীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না। আপিলকারী সাতজনের মধ্যে পাঁচজন তদন্তের সময় ও দুজন বিচারের সময়ে গ্রেপ্তার হন। এই আপিলকারীরা আগে ঘটনাস্থলে নিহতদের (পাঁচ জঙ্গি) সহায়তা ও প্ররোচিত করেছে, যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে দেখা যায়, আপিলকারীরা আগে নিহতদের (পাঁচজন) ওই ঘটনাটি সংঘটনে ষড়যন্ত্রসহ সহায়তা ও প্ররোচিত করার কারণে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(আ) ধারার অপরাধে সব আপিলকারী (সাতজন) দোষী। ট্রাইব্যুনাল ওই আইনের ধারা ৬(১)(ক)(অ)(আ) সঠিকভাবে উপলব্ধি না করে এবং ঘটনাস্থলে নিহত মোবাশ্বের, ইমতিয়াজ, নিবরাস, উজ্জ্বল ও পায়েলের সঙ্গে একীভূত করে ৬(১)(ক)(অ) ধারায় উল্লিখিত প্রচেষ্টা গ্রহণ এবং দণ্ডবিধির ৩৪ ধারায় বর্ণিত একই অভিপ্রায় উল্লেখে ওই আইনের ৬(২)(ক) ধারায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। যা সঠিক ও আইনানুগ নয় বলে রায়টি হস্তক্ষেপযোগ্য।

আদালত আরও বলেন, ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ধারা ৬(১)(ক)(আ) ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আপিলকারী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, আসলাম হোসেন, মো. আবদুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মো. হাদিসুর রহমান, মো. শরিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদকে আইনের ৬(২)(আ) ধারায় বর্ণিত সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। আলোচ্য মামলায় দেশি-বিদেশি ২০ জন নাগরিকসহ দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে যে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা ছাড়া এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডটি জনসাধারণের মনে চরম আতঙ্ক সৃষ্টিসহ জননিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে।

রায়ে আরও বলা হয়, এ অবস্থায় আপিল বিভাগের ‘আতাউর মৃধা ওরফে আতাউর বনাম রাষ্ট্র’ মামলার নজিরের ১৭৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পর্যবেক্ষণের মর্ম অনুসারে আপিলকারীদেরকে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। সে মতে প্রত্যেককে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হলো। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল আপিলকারীদের (যার যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৭, ৮ ও ৯ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া দণ্ড আইনানুগ হওয়ায় তা বহাল রাখা হলো। এই মামলায় দেওয়া সব দণ্ড একত্রে চলবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন আদালত।  

আদালতে আসামিপক্ষে আইনজীবী মো. আরিফুল ইসলাম ও আমিমুল এহসান জুবায়ের শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নির্মল কুমার দাশ। এ ছাড়া আসামি পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত হিসেবে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এস এম শফিকুল ইসলাম।

মক্কেলের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আমিমুল এহসান জুবায়ের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারিক আদালতের রায়ে আসামিরা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। তবে আসামিরা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয় বলে হাইকোর্টের রায়ে এসেছে। তারা অপরাধ সংগঠনে ষড়যন্ত্র, সহায়তা ও প্ররোচনায় জড়িত ছিলেন। অর্থাৎ আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার পরিবর্তে ৬(১)(ক)(আ) ধারায় অপরাধ করেছেন। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু বিচারিক আদালত ভুল করে ৬(১)(ক)(অ) ধারার অপরাধের জন্য ৬(২)(অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। হাইকোর্ট ৬(১)(ক)(আ) ধারার অপরাধের জন্য ৬(২)(আ) ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন।’