স্তন ক্যানসারের প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রয়োজন
স্তন ক্যানসারে রোগী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তাই রোগের খবর জানানোর পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগীকে বোঝাতে হবে, এটি চিকিৎসাযোগ্য রোগ, চিকিৎসা নিলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে রোগীর ভয় দূর করতে হবে।
‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট এবং জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নেন তিনি। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন নাসিহা তাহসিন। ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে এসকেএফ অনকোলজি।
এখনো স্তন ক্যানসার নিয়ে রয়েছে নানা ভ্রান্ত ধারণা ও সচেতনতার অভাব। তাই প্রতিবছর অক্টোবর মাস ‘স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস’ হিসেবে পালন করা হয়। আলোচনার এ পর্বে স্তন ক্যানসার নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম। পর্বটি সোমবার (২০ অক্টোবর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্তন ক্যানসার সম্পর্কে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, ক্যানসার হচ্ছে কোনো কোষের অনিয়ন্ত্রিত, অস্বাভাবিক ও ক্রমাগত বৃদ্ধি। এটি স্তনের বিভিন্ন কাঠামো থেকে হতে পারে, যেমন ডাক্ট বা ডাক্টাল কার্সিনোমা, লোবিউল বা লোবিউলার কার্সিনোমা, রক্তনালি, লিম্ফ্যাটিক স্ট্রাকচার ইত্যাদি। যেমন কার্সিনোমা, সারকোমা হতে পারে অথবা ভাসকুলার সাইড থেকেও ক্যানসার সৃষ্টি হতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক স্তন ক্যানসারের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো সম্পর্কে জানতে চান। উত্তরে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, ‘স্তন ক্যানসারের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণযোগ্য ও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য। অনিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে রয়েছে বয়স, লিঙ্গ, জেনেটিক মিউটেশন ইত্যাদি। নারীরা তুলনামূলকভাবে এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। অল্প বয়সে মাসিক শুরু হওয়া, দেরিতে মেনোপজ এবং অতীতে স্তনে রেডিয়েশন থেরাপি নেওয়া—এসব কারণও ঝুঁকি বাড়াতে পারে।’
ডা. রওশন আরা বেগম আরও বলেন, নিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, ফাস্ট ফুড বা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, স্থূলতা (ওবেসিটি), মেনোপজের পর হরমোন থেরাপি নেওয়া, ৩৫ বছরের পর প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়া, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো এবং নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চার অভাব। এই রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ বা মডিফাই করা যায়।
স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং
স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং প্রসঙ্গে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং দুইভাবে করা হয়ে থাকে। নরমাল পপুলেশনের ক্ষেত্রে ২০ বছর বয়স থেকে সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন এবং ৪০ বছর বয়সের পর ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন, আলট্রাসনোগ্রাম, ম্যামোগ্রাফি বা প্রয়োজনে এমআরআই অব ব্রেস্ট। তবে হাই রিস্ক পপুলেশনের ক্ষেত্রে যে বয়সে পরিবারের কেউ বা আত্মীয় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার ১০ বছর আগে থেকে স্ক্রিনিং শুরু করা হয়। এর মধ্যে আছে মাসিক সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন, ৬ মাস পরপর ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন, ম্যামোগ্রাফি (ডিজিটাল ম্যামোগ্রাফি, টোমোসিন্থেসিস) এবং কম বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে এমআরআই।
‘হাই রিস্ক পপুলেশন’ সম্পর্কে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, যাঁদের পরিবারে স্তন ক্যানসার বা ডিম্বাশয় ক্যানসারের ইতিহাস রয়েছে, অথবা জেনেটিক টেস্টে ঝুঁকি শনাক্ত হয়েছে, তাঁদেরই হাই রিস্ক পপুলেশন বলা হয়।
এরপর উপস্থাপক ম্যামোগ্রাম সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, ম্যামোগ্রাম ক্ষতিকর নয়। এতে খুব সামান্য রেডিয়েশন থাকে, যা ঝুঁকির তুলনায় অনেক কম। এটি ক্যানসার শনাক্তের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রাথমিক পরীক্ষা। তবে ম্যামোগ্রাম অল্প বয়সে বা অপ্রয়োজনে করা উচিত নয়।
সব ধরনের স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা কি একই রকম? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, না। এর চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যানসারের ধরন, রোগীর বয়স, ক্যানসারের স্টেজ, চিকিৎসাসুবিধা ও ফলোআপের ওপর। প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রয়োজন।
স্তন ক্যানসারের সারভাইভাল রেট কেমন জানতে চাওয়া হলে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, এটি স্তন ক্যানসারের ধাপ বা স্টেজের ওপর নির্ভর করে। স্টেজ জিরো বা ‘ইন সিটু’ পর্যায়ে রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। স্টেজ ওয়ানে এ হার ৯৮ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। স্টেজ টুতে গড়ে প্রায় ৮৫ শতাংশ। স্টেজ থ্রিতে এ হার কমে দাঁড়ায় ৫৫ থেকে ৭৫ শতাংশে। আর সর্বশেষ পর্যায়, অর্থাৎ স্টেজ ফোর বা মেটাস্ট্যাটিক ক্যানসারে বেঁচে থাকার হার শূন্য থেকে ২০ শতাংশ।
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা প্রসঙ্গে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, প্রাথমিক ধাপে সাধারণত প্রথমে সার্জিক্যাল চিকিৎসা করা হয়। যদি স্তন সংরক্ষণের (ব্রেস্ট কনজারভেশন) ইচ্ছা থাকে, তবে সার্জারির পর রেডিওথেরাপি নিতে হয়। অ্যাডভান্সড স্টেজে বা স্তন সংরক্ষণ সম্ভব না হলে ম্যাসটেকটমি (স্তন অপসারণ) করা হয়। সার্জারির আগে কেমোথেরাপি (নিওঅ্যাডজুভেন্ট) দেওয়া হয় টিউমার ছোট করার জন্য বা স্তন সংরক্ষণকে সম্ভব করার লক্ষ্যে। পুনরায় ক্যানসার ফিরে আসার ঝুঁকি কমাতে সার্জারির পর টিউমারের স্থানে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। সার্জারির ধরন হিসেবে মূলত দুটি পদ্ধতি প্রচলিত। একটি হলো অনকোপ্লাস্টিক ব্রেস্ট সার্জারি, যেখানে স্তন সংরক্ষণ করে টিউমার অপসারণ করা হয়। অন্যটি হলো র্যাডিক্যাল ম্যাসটেকটমি, যেখানে পুরো স্তন ও আশপাশের লিম্ফ নোড অপসারণ করা হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আসলে কোন স্টেজে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন? জানতে চাইলে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে এখনো অনেক রোগী অ্যাডভান্স স্টেজে আসেন। অনেকে বড় টিউমার, ঘা, দুর্গন্ধ নিয়ে আসেন বা ক্যানসার লিম্ফ নোড বা স্কিনে ছড়িয়ে যাওয়ার পরও আসেন। আবার অনেকে রোগনির্ণয় হওয়ার পরও হোমিওপ্যাথি খেয়ে সময় নষ্ট করেন। বর্তমানে প্রাথমিক স্টেজেও রোগী পাওয়া যায়, তবে অ্যাডভান্স স্টেজে আসা রোগীর সংখ্যাও অনেক বেশি।’
আলোচনার শেষ পর্যায়ে ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, এ বছরের স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাসের প্রতিপাদ্য—‘চিকিৎসাসমতা’। অর্থাৎ প্রত্যেক রোগী যেন তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা পান। তাই রোগীর জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে উপযুক্ত চিকিৎসা নির্ধারণ করতে হবে এবং তাঁকে বোঝাতে হবে যে তিনি কোনো বৈষম্যের শিকার নন। প্রত্যেকেরই সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। পাশাপাশি পুনর্বাসন বা রিহ্যাবিলিটেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে চিকিৎসা শেষে একজন রোগী সমাজে নিজেকে আবারও প্রয়োজনীয় ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে অনুভব করতে পারেন।