চরম আবহাওয়া মোকাবিলায় বাংলাদেশ কেন হিমশিম খাচ্ছে

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। প্রতিবেদনটি করেছেন সাংবাদিক তাসলিমা বেগম

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটিত নানা দুর্যোগ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছেফাইল ছবি: রয়টার্স

শাহানাজ আলী যত দূর মনে করতে পারেন, ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে তিনি ছুটে চলছেন। তিনি বলেন, ক্রমাগত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়াটা ক্লান্তিকর। কোথাও বাড়ির মতো মনে হয় না।

১৯৭০ সালে শাহানাজের পরিবার প্রথম নিজেদের বাড়িঘর ছাড়ে। তখন ঘূর্ণিঝড় ভোলায় বিধ্বস্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। দেশের ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি।

ঘূর্ণিঝড়টিতে শাহানাজের দাদা-দাদিসহ প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড়ের শিকার বাঙালিদের প্রতি ক্ষমতাসীন পাকিস্তান সরকারের অপর্যাপ্ত সাড়া মূলত এক বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সূত্রপাত করেছিল।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে আকার–আকৃতি দিতে থাকে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশটির অনন্য ভূগোল ও নিম্নভূমির ভূগোল একে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। তবুও প্রতিকূলতার বিপরীতে বাংলাদেশিরা যতটা সম্ভব মানিয়ে নিয়েছে।

ঢাকার একটি শীর্ষস্থানীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইসিসিসিএডি) একটি নতুন প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, দেশটি চরম আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে জলবায়ুঘটিত নানা ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ফলে বর্তমান নীতি, অভিযোজন কৌশল দেশটির জনগণ, অবকাঠামো ও বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষার জন্য শিগগিরই অপর্যাপ্ত হয়ে পড়বে।

২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, বন্যা, খরাসহ ১৮৫টি চরম আবহাওয়ার ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে।

বাংলাদেশ ২০০৫ সালে জাতীয় অভিযোজন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এই ধরনের কর্মপরিকল্পনা প্রথম প্রণয়নকারী স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখন বাংলাদেশ অভিযোজন ও স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক নেতা হিসেবে স্বীকৃত।

সরকারি নীতি ও স্থানীয় উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বাজে প্রভাব এড়াতে সক্ষম হয়েছে। তারা লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ভোলায় প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২২ সালের ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে এই মৃত্যু কমে দাঁড়ায় ৩৫।

আইসিসিসিএডির উপপরিচালক ও গবেষণা প্রতিবেদনের অন্যতম প্রধান লেখক অধ্যাপক মিজান খান বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত দশকগুলোর তুলনায় এমনকি চলতি শতকের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে আরও দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বাড়তে পারে।

অধ্যাপক মিজান খান বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত ১৯৭১-২০০০ সালের তুলনায় নদীর তীর প্লাবিত করার আশঙ্কা ১৬ শতাংশ বাড়তে পারে, যা বন্যার অনিবার্য ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এটি ইতিমধ্যে যা দেখা যাচ্ছে, তার চেয়ে আরও বেশি ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি সত্ত্বেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃণমূল পর্যায়ে এবং নীতির কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়ে গেছে।

৩৬ বছর বয়সী শাহানাজ এখন বরিশালে বসতি স্থাপন করেছেন। নিজের কমিউনিটিকে আরও জলবায়ু সহনশীল হয়ে উঠতে সাহায্য করতে তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত নারী নেতৃত্বাধীন একটি দুর্যোগে কাজ করা দল হাটখোলা স্কোয়াডে যোগ দিয়েছেন।

ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমের আগে প্রতিবেশীদের প্রস্তুতিতে সহায়তায় এই নারীরা ঘরে ঘরে যান। কখন ও কীভাবে নিরাপদে সরে যেতে হবে, তা যাতে তাঁরা জানেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এই নারীদের রূপান্তরমূলক, সংঘবদ্ধভাবে কাজের পদ্ধতি অন্যদের এই দলে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছে। ২৩ বছর বয়সী নিপা খাতুন এই দলের তরুণ সদস্যদের একজন। তিনি এই কাজকে সাংস্কৃতিক গৎবাঁধা বিষয়কে চ্যালেঞ্জ করার একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন।

নিপা খাতুন বলেন, জরুরি অবস্থার সময় এই ধরনের বাস্তবসম্মত উপায়ে সাহায্য করাটা নারীদের জন্য গতানুগতিক ব্যাপার নয়। তিনি মনে করেন, এখন তাঁর অনেক বেশি সম্মান আছে। তাঁকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এই নারীদের কাজ হুমকির মুখে। সীমিত অর্থায়নের কারণে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট এই কমিউনিটির মাত্র আড়াই হাজার মানুষকে সহায়তা করতে সক্ষম। যদিও আরও অনেককে সাহায্য করার দরকার।

বাংলাদেশের অভিযোজনের সীমাবদ্ধতার দিকে নজর দেওয়া প্রতিবেদনগুলোর অন্যতম হচ্ছে আইসিসিসিএডির প্রতিবেদনটি। এটি প্রধান লেখক অধ্যাপক সালিমুল হককে উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রখ্যাত এই বাংলাদেশি বিজ্ঞানী আইসিসিসিএডির পরিচালক ছিলেন। তিনি গত অক্টোবরে মারা যান।

প্রতিবেদনে এই উপসংহার টানা হয়েছে, জলবায়ু-সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা অব্যাহত রাখতে একাধিক পদক্ষেপের প্রয়োজন। এগুলো হলো জাতীয় সমন্বয় ও সরকারি বিনিয়োগ; স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন; ন্যায্য ক্ষয়ক্ষতি তহবিল; নিরাপত্তার জন্য বড় মাপের স্থানান্তর, কম কার্বন নিঃসরণ করে এমন জ্বালানি।

অধ্যাপক মিজান খান বলেন, ‘আমাদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অবশ্যই মানুষের ঝুঁকির দিক বিবেচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়ন করতে হবে এবং অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। কারণ, এই প্রতিকূলতাগুলো প্রতিরোধ করার মতো কোনো উপায় তাদের কাছে নেই।’

অধ্যাপক মিজান খান আরও বলেন, উন্নয়ন সহযোগীদের স্থানীয় অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার তার বার্ষিক বাজেটের প্রায় ৭ শতাংশ জলবায়ু অভিযোজনে ব্যয় করে। যার প্রায় ৭৫ শতাংশ আসে দেশীয় উৎস থেকে। যা-ই হোক, জাতীয় অভিযোজন কর্মপরিকল্পনায় বর্ণিত ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়নে বর্তমান খরচের সাত গুণ দরকার হবে।

গত বছরের শেষ দিকে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৮) বিশ্বনেতারা জলবায়ু সংকটের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে সহায়তার জন্য ৭০ কোটি ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতি তহবিল চুক্তিতে সম্মত হন।

তহবিলের আকার এবং এর পরিচালনার ভার বিশ্বব্যাংকের হাতে থাকা নিয়ে অবশ্য উদ্বেগ রয়েছে। এখানে অনুদানের পরিবর্তে ঋণের কথা বলা হয়েছে, যা দুর্বল দেশগুলোর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে তুলবে।

বাংলাদেশ জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা পূরণে অনুদানের ভিত্তিতে তহবিলের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে, অভিযোজনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

সাবের হোসেন চৌধুরী আরও বলেন, ‘যদিও আমরা ক্ষয়ক্ষতির তহবিলকে স্বাগত জানাই, তবে তা প্রয়োজনীয়তার ধারেকাছেও নেই। আরও তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি অভিযোজন পরিকল্পনা যাতে দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর হয়, তা নিশ্চিত করতে এটির উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়াতে হবে।’

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার নই, এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা বিশ্বনেতা।’ ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য খাত থেকে ৪০ শতাংশ জ্বালানি পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন মন্ত্রী।

যা-ই হোক, ত্বরিত পদক্ষেপ সত্ত্বেও অব্যাহত উষ্ণতা ও চরম আবহাওয়া বাংলাদেশের অভিযোজন প্রচেষ্টার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। জীবন–জীবিকা রক্ষা করা কঠিন করে তুলবে। এসব বিষয় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরছে।

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা শুধু আমাদের সীমান্তেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সীমান্ত ছাপিয়ে যাবে। ঘটনা কোথায়, প্রশ্ন তা নয়। কখন হবে, প্রশ্ন সেটা। এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। আমাদের সবাইকে এক হতে হবে। আমরা এটি যে গতিতে তৈরি করছি, তার চেয়ে দ্রুত এর সমাধান করতে হবে।’