এই ভূখণ্ডের একরোখা বৈষম্যের ইতিহাস 

কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভছবি: সুপ্রিয় চাকমা। রাঙামাটির উত্তর কালিন্দীপুর। ১৮ জুলাই ২০২৫

১৯৮০-র দশকে আসাদ গেটের সামনে আমার স্কুল সেন্ট জোসেফ। একদিন শুনি সামনের কাতারের ছাত্র চিৎকার করে বলছে, ‘এই দেখ দেখ, চিঙ্কু যায়!’ চীনা লোক? মাও সে–তুংয়ের হাজার ফুল? তারা মোহাম্মদপুরে কী করছে, এই আদি ১৯৮৫ সালে? ভালোমতো তাকিয়ে দেখি গেটের বাইরে একজন আদিবাসী ছেলে। সে পাহাড়ি না সমতলের, বাংলাদেশের ২৭টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের কোনটি—তাতে কিছু আসে যায় না। মুখের গড়নের কারণে বাঙালি, প্রধানত বাঙালি মুসলমান, ছাত্ররা তাঁকে নিষ্ঠুর বর্ণবাদী গালি দেওয়ার অধিকার পেয়ে গেল।

১৪ বছর বয়সে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে যাই, কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্প দেখতে। মেশিনের শব্দ প্রচণ্ড। তার ওপর দিয়ে আমার চাচা যন্ত্রপাতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি সবেমাত্র বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর প্রকৌশলী কৌতূহল জলবিদ্যুৎ নিয়ে। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, মেশিনগুলো ছিল প্রযুক্তিগত বিস্ময়। আমি স্কুলে ফিরে একটি বিজ্ঞান প্রকল্পের স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু এই বিদ্যুৎজাদুর পেছনে ১৯৬৫ সালে চাকমা সম্প্রদায়ের হাজার হাজার পরিবার ও গ্রামের উচ্ছেদের ঘটনা আমার চাচা হয়তো জানতেন না। নির্মম সেই ঘটনামালা প্রকাশিত হতে লেগেছে বহু দশক। অতি সম্প্রতি অ্যাডভোকেট সমারী চাকমা লিখেছেন মৌখিক ইতিহাসের যুগান্তকারী কাজ কাপ্তাই বাঁধ বর-পরং: ডুবুরিদের আত্মকথন (ইউপিএল, ২০২৪)।

সেন্ট জোসেফ শিক্ষা পর্ব শেষ করার পরে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার যাই। এবার আমার সঙ্গী জুম্ম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কর্মীরা, তাঁদের মধ্যে সমারি চাকমাও ছিলেন। সে সময়ে দেখি, আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের রূপকথা (‘বাংলাদেশে সকল জনগোষ্ঠী মিলেমিশে থাকে’) এবং জুম্ম জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনের বাস্তবতার মধ্যে এক বিশাল ফারাক। আমি ভাবতাম, বোধ হয় শুধু একাত্তরের প্রজন্মেরই এই দেখার ভুল। তারা মেঘের অনেক রং চলচ্চিত্র (১৯৭৬) এবং সেটির অভিনেত্রী মাথিনকে নিয়ে পত্রিকার প্রচ্ছদকাহিনি করে ক্ষান্ত হয়েছে। পরের দশকে বুঝেছি বাঙালি মুসলমান পুরুষের পক্ষে ভিন্ন জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গকে সমান কাতারে না দেখার রেওয়াজ কোনো প্রজন্ম ভাঙতে পারেনি।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পর ‘কী পেলাম’-জাতীয় বিষয়ে গোলটেবিল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাগ্​যুদ্ধ চলছে। আলোচনার স্বরে চলে এসেছে অবসাদের ছায়া। ঘটনাপ্রবাহ এবং বিশেষত আবারও নারী অধিকার খর্বের জলসা দেখে, বিজয় প্রসাদের আরব বসন্ত, লিবিয়ার শীত (একে প্রেস, ২০১২) বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। প্রসাদের বয়ানে পশ্চিমা দেশের সহায়তায় লিবিয়ার গাদ্দাফিকে উৎখাত করার পর আরব বসন্তের আশা ধূলিসাৎ হয়। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় ‘আমরা সবাই রাজা’ জোশে স্থায়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যার অবসান আজও ঘটেনি। তবে প্রসাদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলা যায়, বসন্তের মৃত্যুঘণ্টা সবার আগে সেই মিসরের তাহরির স্কয়ারেই শোনা যায়। তাহরিরে যুব-বিপ্লবের মধ্যেও কিছু সাংবাদিক লেখেন যে নারী অধিকার প্রশ্নে ইতিমধ্যে বিপজ্জনক সংকেত দেখা যাচ্ছে। হোসনি মোবারকের পতনের পর আসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতা ছিলেন আরেক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, মোহাম্মদ আল বারাদায়ী। বারাদায়ীর অধীনে এক অস্থির পরিস্থিতি, অবশেষে নির্বাচনে এককালে নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুডের বিজয় এবং এক বছর পর ব্রাদারহুডের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথমে রাস্তার আন্দোলন এবং পরে মুরসির সেনা অভ্যুত্থান।

সমতল থেকে পাহাড়ে সমান অধিকারের দাবিতে গ্রাফিতি
ছবি: প্রথম আলো। বান্দরবান। ১৪ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের ইতিহাস বর্তমান মিসরের মতো নয়। আবার এই বাংলাদেশ সেই আগের বাংলাদেশও নয়। এত বছর সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার পর আসলে কে জিতবে, সে ব্যাপারে নানা ধোঁয়াশা আছে এবং থাকবে। বাম প্রগতিশীল এবং নারীবাদী রাজনীতিকে কোণঠাসা করে ডানপন্থী কর্তৃত্ব এই অভ্যুত্থানের বিফলতা। তবে আন্দোলনের আশাবাদী মুহূর্তেও আশা-নিরাশার বলয়ে আদিবাসী সমাজ ভুগেছে সবচেয়ে বেশি। ১৯৪৭, ১৯৬২, ১৯৭১, ১৯৭৬, ১৯৮১, ১৯৯০, ২০০৭, ২০২৪—পূর্ববঙ্গ, তারপর পূর্ব পাকিস্তান এবং সর্বশেষে বাংলাদেশের বহু পটপরিবর্তনের মাইলফলকে পৌঁছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সবার আগে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায়, এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আমরা মব স্বৈরতন্ত্রের আশু প্রকাশ দেখি আদিবাসী মিছিলের ওপর ‘অজ্ঞাত’ আততায়ীদের আক্রমণে। আবার এই সরকারের আমলেই পাঠ্যপুস্তকের অলংকরণে গাছের পাতায় ‘আদিবাসী’ লেখার দায়ে পুরো পুস্তক পরিবর্তনের চাপ আসে।

এই ভূখণ্ডের প্রতিটি পটপরিবর্তনের সময় ‘কে বা কাহারা’ আমাদের আদিবাসী সম্প্রদায়কে সবার আগে কোণঠাসা করেছে। ১৯৪৭ সালের বিতর্কিত র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ যদি ইসলাম ধর্ম-প্রধান পাকিস্তানের সীমানা এঁকে দেয়, তাহলে কি যুক্তিতে ৯০ শতাংশের বেশি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পার্বত্য চট্টগ্রাম সেই পাকিস্তানের ভেতরে পড়ে? পাকিস্তান আমলে যখন ১৯৬২ সালে প্রথম ‘উন্নয়ন মহাপ্রকল্প’ পূর্ব পাকিস্তানে আসে, সেই কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ বাঁধ হাজার হাজার চাকমা পরিবারকে জলোচ্ছ্বাসে ডুবিয়ে ফেলে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর আসে আরেক আইনি আগ্রাসন, নতুন দেশের সংবিধান বলে দেয়, এই ভূখণ্ডে সবাই বাঙালি। আইনিভাবে জাতিসত্তা মুছে ফেলার অভিযানের বিপক্ষে বাংলাদেশ সংসদে প্রথম ‘না’ আসে মানবেন্দ্র লারমার গলায়। জবাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র আদিবাসীদের হুকুম করে, ‘তোমরা বাঙালি হয়ে যাও।’ অথচ দুই দিন আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ‘উর্দু শেখো, পাকিস্তানি হও’ স্লোগানের বিপক্ষে এই বাঙালিরাই বলেছিল, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’

সমতল থেকে পাহাড়ে সমান অধিকারের দাবিতে গ্রাফিতি
ছবি: প্রথম আলো। বান্দরবান। ১৪ আগস্ট ২০২৫

পরবর্তীকালে আদিবাসী সম্প্রদায় সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। দুই দশক ধরে ‘শান্তি বাহিনী’ গেরিলা আন্দোলন করার পর ১৯৯৭ সালে আসে শান্তিচুক্তি। কিন্তু পরের দুই দশক বাংলাদেশের কোনো সরকার সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি; বরং ক্রমাগত নতুনভাবে আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, জমি এবং অধিকার হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই স্লোগান, ‘বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বলে কিছু নাই’। ফেসবুক পোস্ট দেখে বোঝা যায় তরুণ প্রজন্মকেও নিপুণভাবে বোঝানো হয়েছে যে পাহাড়ের এই রক্তাক্ত ইতিহাসে বাঙালিই ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত। তাই অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি আফ্রিকার ইতিহাস ঘেঁটে লিখেছেন অত্যাচারিতই আবার হয়ে যায় খুনি (প্রিন্সটন প্রেস, ২০০১)।

২০১০ সালে ‘দৃষ্টিপাত লেখক সংঘ’-এর ব্যানারে প্রকাশ করেছিলাম ছাই এবং আশার মাঝে: বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অন্ধ গলিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে একটি বই। প্রকাশনা উৎসবে একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন? দেশে তো অনেক সমস্যা।’ দেশে আসলেই অনেক সমস্যা। হিন্দু সম্প্রদায়, নারীর সম-অধিকার, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, কৃষি বাঁচলে গ্রাম বাঁচে, পরিবেশ বাঁচাও—কোনো অধিকারের লড়াই-ই তো শেষ হলো না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো বাঙালি (এবং বাংলাদেশি) জাতীয়তাবাদের বিফলতার কেন্দ্রবিন্দু। পাহাড়ের ইতিহাস পাকিস্তান থেকে মুক্তির ইতিহাস (একাত্তর) এবং আমাদের জুম্ম নাগরিকদের ওপর সেই একই আধিপত্য (ভাষা, নিরাপত্তা, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন) পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে একটি অব্যাহত দ্বন্দ্ব প্রকাশ করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভেতর আছে এক ক্রমাগত আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণবাদ—যা দখল করে, প্রান্তিক করে এবং স্থানচ্যুত করে। 

সমতল থেকে পাহাড়ে সমান অধিকারের দাবিতে গ্রাফিতি
ছবি: প্রথম আলো। বান্দরবান। ১৪ আগস্ট ২০২৫

বিজয়ীরা বারবার ইতিহাস মুছে পুনর্লিখন করে। ১৯৯৭ সালের ‘শান্তিচুক্তি’ পূরণ না করে বরং ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’, ‘জমির অধিকার সবার’ ইত্যাদি আওয়াজ তুলে আদিবাসী অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আদিবাসীদের পাল্টা আখ্যান তৈরি করেছে জুম্ম কণ্ঠস্বর, কিছু বাঙালি রাজনৈতিক সঙ্গী এবং কয়েকটি বাম-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার পারল না, এমনকি চাইল না, এই ঐতিহাসিক বৈষম্য ভাঙতে।

আশা করি ২০২৬ সালে নির্বাচিত সরকার অবশেষে সম-অধিকারের আন্দোলনে নামবে। পাহাড় থেকে সমতল, আদিবাসী থেকে বাঙালি এবং অবশ্যই সব ধর্ম-সম্প্রদায় এ দেশের সমান নাগরিক।

নাঈম মোহায়মেন: যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা বিভাগের স্নাতক অধ্যয়ন পরিচালক

[email protected]