অন্য এক বিদ্রোহী নজরুল

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে পাঠকের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

যমুনার ভাঙনের দুড়ুম দুড়ুম শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেটেছে আমার শৈশবের পড়াশোনা। ঘর, বাজার, স্কুল ভবন নদীগর্ভে বিলীন হতে দেখেছি। পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি কত বন্ধু। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরের পাট চুকিয়েছি সম্প্রতি। শিক্ষাজীবনের ফেলে আসা নানা স্মৃতি মনে ছবির মতো ভেসে ওঠে। কানে বাজে নজরুল স্যারের কোমলে-কঠোরে মেশানো সেই দরাজ গলা।

১৯৯৪ সালে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চর মানিকদাইড়ে ছোট কোঁকড়া চুলের এক তরুণ শিক্ষকের আগমন ঘটে। সারিয়াকান্দি ঘাট থেকে দুই ঘণ্টা নৌকায় পাড়ি দিয়ে সেই চরে পৌঁছাতে হয়। ওপরে টিনের চালা, চারপাশে ছনের বেড়া—এমন একটা ছোট্ট ঘর নিয়ে একটা প্রাইমারি স্কুল। ছাত্রছাত্রীদের বসার জন্য মেঝেতে পাটের চট আর স্যারের জন্য দুর্বল পায়ার নড়বড়ে এক চেয়ার। এই দুর্গম চরের মানুষেরা তখন সকাল-রাত দুবেলা দুমুঠো করে ভাত খায়। আর দুপুরে কখনো গমের ছাতু, কখনোবা পানি খেয়েই দিনাতিপাত করে। টগবগে সেই স্যারের দুপুরের খাবারের জন্য কয়েকটা নোনতা বিস্কুট পাঠানো হতো সাইদুর চেয়ারম্যানের বাসা থেকে।

খবরটি জানতে পেরে স্যারের বাড়ির লোকেরা সেই চরে চাকরি করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু নজরুল স্যারের কানে বাজতে লাগল আরমান ব্যাপারী নামের এক চরবাসীর সেই বিষণ্ন কণ্ঠ, ‘দুই দিন পরেই আংগের থুইয়া আপনেও চইল্যা যাইবেন। কোনো মাস্টারই থাকপ্যার চায় না এহেনে।’

চর ছাড়লেন না নজরুল স্যার। নজরুল স্যার সেই চরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুল গড়ে তোলার কাজে হাত দিলেন।

স্যারের প্রচেষ্টায় ভাঙা টিনের চালের বদলে পাকা ভবন হলো স্কুলে। নিজের বেতনের টাকা কিংবা কখনো কখনো বাসা থেকে টাকা এনে পুরো স্কুলকে সাজাতে হাতে নিলেন নানা কাজ। স্কুলের পুরো বাউন্ডারি-সংলগ্ন ফুলের বাগান, অসংখ্য ফলের গাছ আর বর্ণিল অফিস রুম।

নজরুল স্যার স্কুলের ভবনের সামনের দেয়ালে বড় করে লিখলেন, ‘শিক্ষার জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও।’ আমরা স্কুলে যারা আবাসিক ছিলাম, তারা রুটিন করে প্রতি ভোরে বাগানে পানি দিতাম। অজপাড়াগাঁয়ের সে স্কুলে তিনি শুরু করলেন ক্লাস ফোর ও ফাইভের ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক আবাসিকে থাকার ব্যবস্থা। সকালে খেয়ে সারা দিন স্কুলে পড়াশোনা, তারপর বিকেলে বাসায় গিয়ে রাতের জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে এসে হারিকেনের চিমনি মুছতে মুছতে স্যারের সঙ্গে জমজমাট গল্পে আমাদের সন্ধ্যা নামত। তারপর রাত ১০-১১টা পর্যন্ত লেখাপড়ার পর ঘুমিয়ে যেতাম।

এসবেও মন ভরল না নজরুল স্যারের। এক অভিনব ব্যবস্থা বের করলেন তিনি। সব ছাত্রছাত্রী সন্ধ্যায় আবারও স্কুলে হারিকেন নিয়ে এসে রাত ১০টা পর্যন্ত পড়ে অনাবাসিক যারা তারা যাতে নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারে, সে ব্যবস্থা করলেন। কেউ স্কুলের মাঠে, কেউ ছোট ছোট ফুলের গাছের মাঝখানে, কেউ স্কুলের প্রবেশপথে, কেউবা একেবারে বাউন্ডারির শেষ সীমানায় বেঞ্চ নিয়ে বসে পড়ত। সারা স্কুলের প্রাঙ্গণে হারিকেনের আলোগুলোকে একঝাঁক জোনাকির মতো লাগত।

একদিন সন্ধ্যায় স্কুলে আবাসিকে হাজির না হয়ে বাড়িতে ঘুমিয়ে গেছি। রাত নয়টার দিকে এক ভারী কণ্ঠে ঘুম ভাঙল। আধঘুম নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি নজরুল স্যার আমাদের বাড়িতে এসেছেন হবি স্যার, শাহিদুল স্যার ও সফের স্যারকে নিয়ে। আসামির মতো তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা-বাবাকেও নম্রভাবে শাসালেন, আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে কেন পাঠাননি তাঁরা।

তারপর সময় দ্রুত চলে গেল। চলে এল এক শীতের ভোর। প্রিয় স্যারের সে স্কুল থেকে বিদায়ের ঘণ্টা বেজে উঠেছে। তখন আমরা ক্লাস এইটে পড়ি পাশের চরের এক হাইস্কুলে। নজরুল স্যারের বিদায়ের সেই দিনটায় পুরো গ্রামের মানুষের চোখ ছিল শিশিরে ভেজা দূর্বার ঘাসের মতো। অ্যাসেম্বলির সময় ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ শোনা যাবে না আর।

সেই স্কুলটি কয়েক বছর আগেই যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু স্নাতক-স্নাতকোত্তর হয়ে থেকে গেছে নজরুল স্যারের দুই শতাধিক ছাত্রছাত্রী। প্রিয় স্যার না থাকলে আমার মতো দুর্গম চরের বালুর মধ্যে শৈশব কাটানো বালকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চৌকাঠ মাড়ানো সম্ভব হতো না। তিনি আমাদের নজরুল স্যার, আমাদের চরের ঘরে ঘরে মানিক গড়ে দিয়ে যাওয়া এক বিদ্রোহী নজরুল।


শেখ রাশেদুজ্জামান রাকিব, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়