মধ্যপ্রাচ্যে সহজে চিকিৎসা পান না নিম্ন আয়ের প্রবাসীরা

প্রবাসী
ফাইল ছবি

নিম্ন আয়ের প্রবাসী শ্রমিকেরা মধ্যপ্রাচ্যে সহজে চিকিৎসা পান না। নিয়োগকর্তারা (কফিল) চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে চায় না। দেশগুলোতে স্থানীয় নাগরিক ও অভিবাসীদের চিকিৎসা সুবিধার মধ্যে বৈষম্য আছে। আর যেসব কর্মী নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়েন, তাঁদের চিকিৎসা পাওয়া আরও কঠিন। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে এগুলো ভূমিকা রাখছে। অনেকেই অসুস্থ হয়ে শুধু চিকিৎসার জন্য দেশে ফিরে আসেন।

‘উপসাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি: ভাইটাল সায়েন্স রিপোর্ট-২’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক যৌথ গবেষণা জোট ভাইটাল সায়েন্স। এ জোটের বাংলাদেশি অংশীদার রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান বলেন, ডলার, রেমিট্যান্সের কথা প্রতিদিন শোনা যায়, কিন্তু যাঁরা এটা আয় করেন, তাঁদের জীবনের কান্না কেউ শোনে না। তাঁরা স্বাস্থ্যসেবা পান না। এটা শুধু অবহেলা নয়, এ খাতে দুর্নীতিও থাকতে পারে।

সৌদি আরব থেকে লিভারের অসুস্থতা নিয়ে গত বছর দেশে ফিরে এসেছেন ঢাকার মাদারটেকের নাছিমা আকতার। অনুষ্ঠানে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, গত বছর এপ্রিলে সৌদি আরব যান। প্রথম দিন থেকেই তাঁকে কাজে নামানো হয়। নিয়োগকর্তার ৬ ছেলের বাসায় কাজ করতে হয়েছে। পর্যাপ্ত খাবার দেয়নি। তিন মাস পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা করতে চেয়ে উল্টো নির্যাতিত হয়েছেন। এরপর বাড়ি থেকে ঋণ করে টাকা নিয়ে দেশে ফিরে চিকিৎসা করান।

শুধু সংখ্যাগত দিক নয়, সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, প্রবাসী কর্মীরা কর্মক্ষেত্র ও থাকার জায়গার অবস্থা, পরিবেশ, উচ্চ তাপ ও আর্দ্রতা, দূষণ, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণের কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন। এর পাশাপাশি নারীরা যৌন নির্যাতনের শঙ্কার মধ্যে থাকেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় বেশি, ফলে স্বল্প আয়ের কর্মীরা এটা মেটাতে পারেন না।

কুমিল্লার তাজুল ইসলাম ১১ বছর ওমানে ছিলেন নির্মাণশ্রমিক হিসেবে। গত বছর কাজের সময় ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে দুই পা ভেঙে যায় তাঁর। নিয়োগকর্তা চিকিৎসা করাতে রাজি হননি। বাংলাদেশের দূতাবাসে যোগাযোগ করেও কোনো সহায়তা পাননি। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নিজের টাকায় জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়েছেন। এরপর ধারদেনা করে ২১ দিন পর দেশে ফিরে এসে চিকিৎসা করান।

ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, কাজের বৈধ অনুমতিপত্রের (ইকামা) সঙ্গে প্রতিটি কর্মীকে একটি করে স্বাস্থ্য কার্ড দিয়ে দিলেই চিকিৎসা নিশ্চিত হবে।

প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন রামরুর নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার। তিনি বলেন, প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে একদমই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এটা ঠিক, তাঁরা অন্য দেশে থাকেন। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট দুই দেশ, নাগরিক সমাজ ও বহুপক্ষীয় আলোচনাতেও এটা গুরুত্ব পায় না। প্রবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্যসংকট কতটা ভয়াবহ, করোনা মহামারি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। বৈধভাবে বিদেশে গিয়েও চিকিৎসা না পাওয়ার দায় সবাইকে নিতে হবে।

প্রতিবেদন বলছে, গত মে থেকে জুলাই পর্যন্ত কাতারের ১ হাজার ১০১ জন কর্মীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাবে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে অক্ষম স্বল্প বেতনের অভিবাসীরা। তাঁদের মধ্যে ২৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা জাতিগত বৈষম্যের শিকার এবং পুরোপুরি চিকিৎসাবঞ্চিত হন। সৌদি আরবে সাক্ষাৎকার নেওয়া অভিবাসীরা বলেছেন, স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে অনেকটা নিয়োগকর্তার ওপর। কুয়েতে ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই তাঁরা ব্যথানাশক ওষুধ খেয়েছেন নিয়মিত। মনমোহন কার্ডিয়াক সেন্টারের একজন নেপালি চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছেন, সময়মতো স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারলে অনেক মৃত্যু প্রতিরোধ করা যাবে।

এর আগে গত বছর প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রতিবছর গড়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ১০ হাজার কর্মী মারা যান। তাঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ জানা যায় না। সনদে স্বাভাবিক মৃত্যু ও হৃদ্‌রোগ কারণ হিসেবে দেখানো হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রতিবছর গড়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ১০ হাজার কর্মী মারা যান। তাঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ জানা যায় না। সনদে স্বাভাবিক মৃত্যু ও হৃদ্‌রোগ কারণ হিসেবে দেখানো হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান বলেন, ডলার, রেমিট্যান্সের কথা প্রতিদিন শোনা যায়, কিন্তু যাঁরা এটা আয় করেন, তাঁদের জীবনের কান্না কেউ শোনে না। তাঁরা স্বাস্থ্যসেবা পান না। এটা শুধু অবহেলা নয়, এ খাতে দুর্নীতিও থাকতে পারে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, চিকিৎসায় আগের মতো মানবতা নেই। এতে ব্যবসা ঢুকে গেছে। বাংলাদেশেও এটি দেখা যায়। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চিকিৎসকদের অধিকাংশ বিভিন্ন দেশের। সেখানে প্রবাসীদের চিকিৎসা পাওয়া কঠিন। এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকীম বলেন, প্রবাসীরা ঋণ করে বিদেশে যান। মানসিক চাপ থাকে, বাড়তি পরিশ্রম করেন। তাই হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি থাকে। প্রচুর ব্যথানাশক ওষুধ খান। এতে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্র এদিকে গুরুত্ব দেয় না। তারা ডলার চেনে, রেমিট্যান্স চেনে, রিজার্ভ চেনে। প্রবাসীরা স্বাস্থ্য বোঝেন না, অধিকার বোঝেন না।

ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, কাজের বৈধ অনুমতিপত্রের (ইকামা) সঙ্গে প্রতিটি কর্মীকে একটি করে স্বাস্থ্য কার্ড দিয়ে দিলেই চিকিৎসা নিশ্চিত হবে।  

আর বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে একজন নারী গৃহকর্মীকে দিনে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয় না। এতে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন।

স্বল্প বেতনের বৈধ ও অবৈধ সব অভিবাসী কর্মীর স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। সুপারিশের মধ্যে আরও বলা হয়, গৃহকর্মীদের নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করা এবং কর্মী উপস্থিত হতে না পারলে তাঁর বাসায় স্বাস্থ্যকর্মীর ভিজিট বাধ্যতামূলক করা। উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের সতর্কতায় নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক ওষুধ সেবন বন্ধে প্রচার করা।