‘দুই ছেলে নেই, আমাদের জীবনে আর ঈদ আসবে না’

বাবার সঙ্গে দুই ভাই শাহির মোবারত (৯) ও শায়ান মোবারত (১৫); এই দুই ভাই এখন শুধুই স্মৃতি
ছবি: সংগৃহীত

গত বছর পবিত্র ঈদুল আজহার সময় শায়ান মোবারত (১৫) বাবা মোবারক হোসেনের সঙ্গে হাটে গিয়ে গরু কিনেছিল। গরুর নাম রেখেছিল লাল্টু। শাহির মোবারত (১০) খাসি পছন্দ করত। তবে কোরবানির পর খাসি আর দেখতে না পেয়ে কান্নাকাটি করত, গত বছরও কেঁদেছিল। বাবার হাত ধরে দুই ভাই ঈদের নামাজ পড়তে যেত। বাসায় ফিরে মায়ের হাতের বানানো চটপটি চেটেপুটে খেত। আত্মীয়দের বাড়ি যেত সালামি নেওয়ার জন্য।

এখন এই দুই ভাইয়ের জায়গা হয়েছে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে, কাছাকাছি জায়গায় দুই কবরে তারা। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন (তুষার) ও শারমিন জাহান দম্পতির ঘরে তাই এবার ঈদের কোনো আনন্দ নেই। শারমিন জাহান বললেন, ‘দুই ছেলে নেই, আমাদের জীবনে আর কখনো ঈদ আসবে না।’

৪ জুন কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় মারা যায় এই দুই ভাই। বাসার তেলাপোকা নিধনে ২ জুন একটি বালাইনাশক (পেস্ট কন্ট্রোল) প্রতিষ্ঠান মোবারকের বাসায় কীটনাশক দেয়। ১০ ঘণ্টা পর সবাই বাসায় ফেরেন। এরপর দুই ছেলে আর স্ত্রী বমি করতে থাকেন। দুই ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়লে ৪ জুন তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওই দিনই তারা মারা যায়।

বাবা-মাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ঈদের স্মৃতি

আজ বুধবার মুঠোফোনে কথা হয় মোবারক হোসেন ও শারমিন জাহান দম্পতির সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, এবার ঈদ নিয়ে তাঁদের কোনো আয়োজন নেই। গ্রামের বাড়িতে কোরবানি দিয়ে মাংস দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। উত্তরার ঢাকা রয়্যাল ক্লাব লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট মোবারক হোসেন জানালেন, ক্লাবে আজ একটি গরু জবাই করা হয়েছে। তার মাংসও ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে।

সন্ধ্যায় দুই ছেলের মা শারমিন জাহান বললেন, ‘আজ আমার ছোট ছেলেটার জন্মদিন। অসুস্থ অবস্থায় ছেলেটা কেএফসির ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন খাবে বলেছিল। খাবার আনার পর একটুও মুখে দিল না। ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলাম, পরে যদি খেতে চায়। ও আর এই খাবার খেয়ে যেতে পারল না। তাই আজ ওর পছন্দের খাবার নিয়ে বের হব, রাস্তায় ছিন্নমূল শিশুদের দেব। আমার বড় ছেলে প্রায়ই খাবার নিয়ে বের হয়ে পথে থাকা শিশুদের হাতে খাবার তুলে দিত।’

মোবারক হোসেন জানালেন, জন্মদিনের প্রথম প্রহরে রাত ১২টায় তাঁরা বনানীর কবরস্থানে ছিলেন। ঈদের দিনটিতেও তাঁরা কবরস্থানে যাবেন। তারপর শূন্য ঘরে ফিরবেন। এই দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া শাহরিন মোবারতেরও (জাইমা)  ঈদ নিয়ে বাড়তি কোনো আবদার নেই।

দুই ছেলের প্রসঙ্গ আসতেই মোবারক হোসেন ও শারমিন জাহান স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন। ছেলেরা বেঁচে থাকতে তাদের ঘর যেমন ছিল, তেমনই রাখা হয়েছে। মোবারক হোসেন বললেন, কোরবানির জন্য বড় ছেলের পছন্দ ছিল লাল রঙের গরু। হাটে গিয়ে নিজে গরু পছন্দ করত। খাসি পছন্দ করত ছোট ভাই ও বোনের জন্য। গত বছর ঈদুল আজহায় দুটি খাসির নাম দিয়েছিল পিংকি ও বিংকি। গরু ও খাসিকে গোসল করানো, খাওয়ানোসহ তার ব্যস্ততার অন্ত থাকত না। কোরবানির পর বড় ছেলে মাংস বাসার ফ্রিজ ভরে রাখার বিষয়টি পছন্দ করত না। বলত, যারা সারা বছর খেতে পায় না, তাদের দিয়ে দিতে।

গত ঈদুল ফিতরেও তিন বাপ ছেলে একসঙ্গে নামাজ পড়ে বাসায় ফিরেছিলেন। ওরা মারা যাওয়ার পর ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে তিনজনের তোলা ছবিটিই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে।

কঠোর শাস্তি চান তাঁরা

মোবারক হোসেন ও শারমিন জাহান ছেলেদের মৃত্যুর পেছনে যারা দায়ী, তাদের কঠোর শাস্তি চান। মোবারক হোসেন বলেন, ‘ছোট ছেলেকে বনানী কবরস্থানে রেখে হাসপাতালে এসে শুনলাম, বড় ছেলেও নেই। ভাবতে পারবেন না, তখন আমাদের অবস্থা কেমন হয়েছিল। একই দিনে দুই ছেলেকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। আর কেউ যাতে এমন করে আদরের ধনকে হারিয়ে না ফেলেন, এটাই আমাদের চাওয়া।’