ডাঙ্গাপাড়া, এক বদলে যাওয়া গ্রাম

বেগম রোকেয়া মহীয়সী নারী মহিলা উন্নয়ন সমিতির মাধ্যমে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা পোশাক তৈরি ও বাহারি নকশার কাজ করেন। নারীদের কাজের তদারকি করছেন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাদেকা আক্তার। ৮ এপ্রিল রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

শাবানা বেগমের পরিবারে সদস্যসংখ্যা আট। তিনি নিজে, স্বামী, চার সন্তান, শ্বশুর ও শাশুড়ি। উপার্জনকারী শুধু তাঁর স্বামী আনিসুল হক। দিনমজুরি করে তিনি যা আয় করতেন, তা দিয়ে সংসার চলত না। অভাব লেগেই থাকত।

এখন অবশ্য দিন বদলেছে। শাবানা স্বামীর সঙ্গে নিজেও উপার্জন করেন। তাঁর শাশুড়ি মাসে ৫০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পান। প্রতিবন্ধী একটি সন্তান পায় সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা (মাসে ৮৫০ টাকা)। শাবানা বলছিলেন, ‘সেই কষ্ট আর নাই। ছাওয়াগুলা স্কুল যাওছে, গরু-ছাগলে গোয়াল ভরা। আল্লায় দিলে শান্তিতে আছি।’

শাবানা উপার্জন করেন সেলাই ও কারচুপির (পোশাকে জরি ও পুঁতির নকশা) কাজ করে। ২০১৩ সালে নিজ গ্রামের বেগম রোকেয়া মহীয়সী নারী মহিলা উন্নয়ন সমিতির পক্ষ থেকে তাঁকে সেলাই শেখানো হয়। আর সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় তাঁর পরিবারের দুই সদস্যকে (শাশুড়ি ও প্রতিবন্ধী সন্তান) ভাতা দেয়।

শাবানার মতো রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের অনেক নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন বেগম রোকেয়া মহীয়সী নারী মহিলা উন্নয়ন সমিতির মাধ্যমে। সঙ্গে গ্রামের উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগও রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই গ্রামের রাস্তা পাকা করে দিয়েছে সরকার। ২০১৮ সালে পৌঁছায় বিদ্যুতের সুবিধা। গ্রামে সরকারি একটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

বেসরকারি মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের মাধ্যমে পৌঁছে গেছে ইন্টারনেটও। আর গ্রামের মানুষ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গেলে পান নানা ধরনের সেবা। গ্রামের পাশেই ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অনেকেই ভাতা ও ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যসহায়তার আওতাভুক্ত।

সরকারের অবকাঠামো, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ এবং বেসরকারি উদ্যোগ যে বহু মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে, তার উদাহরণ ডাঙ্গাপাড়া গ্রামটি। গ্রামের মানুষ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামের প্রায় শতভাগ শিশু বিদ্যালয়ে যায়, বাল্যবিবাহ বন্ধে গ্রামের বাসিন্দারা সচেতন, প্রায় সব কটি বাড়িতে আছে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার। অপরাধ নেই বললেই চলে।

ইতিবাচক কোনো পরিবর্তনের শুরুটা হয় কারও হাত ধরে। ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে সেই শুরুটা করেছিলেন সাদেকা আক্তার (৩৮) নামের এক নারী। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন বেগম রোকেয়া মহীয়সী নারী মহিলা উন্নয়ন সমিতি। এই সমিতি নারীদের সেলাই ও কারচুপির কাজের প্রশিক্ষণ দেয়। সমিতির পক্ষ থেকে গরু মোটাতাজাকরণ ও ফসল চাষাবাদ করা হয়। বাল্যবিবাহ রোধ, রক্তদান, শিক্ষাসহায়তা, অসহায় রোগীদের সহায়তাসহ নানা কাজ করে সমিতিটি।

তারাগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের অবস্থান। গ্রামটি বেশি বড় নয়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, গ্রামটিতে প্রায় ৬০০ মানুষের বাস। ৮ এপ্রিল ওই গ্রামে গিয়ে জানা গেল সাদেকার কথা। আঁকাবাঁকা সড়ক পেরিয়ে গ্রামটির পথে ঢুকতেই দেখা যায় সবুজ ফসলের মাঠ। গ্রামে সাদেকার বাড়ির সামনে সমিতির কার্যালয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, উঠানে বসে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে নতুন পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত নারীরা। কেউ জরি বা পুঁতি বসাচ্ছেন, কেউ করছেন সেলাই।

সেখানেই ছিলেন সাদেকা। তিনি জানান, ২০০০ সালে এক দিনমজুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বয়স তখন ১৫। পড়তেন নবম শ্রেণিতে। শ্বশুরবাড়িতেও ছিল অভাব। কোনো বেলা খাবার জোটে, কোনো বেলা জোটে না। ২০০৩ সালের দিকে তিনি গ্রামের নারীদের নিয়ে সমিতি গঠনের উদ্যোগটি নেন।

সাদেকা আক্তার বলেন, তিনি প্রথমে গ্রামের মেয়েদের ডেকে বলেছিলেন, ‘সপ্তাহে ১০ টাকা করে দাও। এটা দিয়ে আমরা কোনো কাজ শুরু করব।’ গঠন করেন সমিতি। তিনি নিজে হস্তশিল্প পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ নেন তারাগঞ্জ পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি কেন্দ্র থেকে। তারপর সেই প্রশিক্ষণ দেন সমিতির সদস্যদের। এখন সমিতির অনেক সদস্য মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আয় করেন এই হস্তশিল্প পণ্য তৈরির কাজ করে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাজের ফরমাশ আসে।

সমিতির সদস্যরা যে টাকা জমান, তা পাঁচ বছর পরপর ভাগ করে নেন। তাঁরা গরু-ছাগল পালন করেন, মাছ চাষ করেন। সদস্যরা জানান, সমিতির সঞ্চয়ের টাকায় কেনা ১০টি গরু বর্গা দেওয়া হয়েছে। ৫০ শতক জমি বন্ধক নিয়ে ধান ও কলা চাষ করা হয়েছে। একটি পুকুর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। সেলাই যন্ত্র কেনা হয়েছে ২০টি।

সমিতিটির নাম কেন বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে রাখা হয়েছে, তা-ও জানান সাদেকা। তিনি বলেন, তাঁর দাদি তাঁকে বেগম রোকেয়ার গল্প শোনাতেন। সেই গল্প শুনেই বেগম রোকেয়ার নামে সমিতির নামকরণের বিষয়টি মাথায় আসে। এখন সমিতির সদস্য ১৩০ জন নারী।

সাদেকার নিজের জীবন বদলেছে। দেখা গেল, যে ঘরে দুই বেলা খাবার জোটানোই কষ্ট ছিল, সেই ঘর পাকা করতে ইট কিনেছেন। বাড়িতে তিনটি গরু, হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালন করছেন। তাঁর স্বামী আবদুল জলিল স্থানীয় বাজারে মনিহারির দোকান চালান। তাঁরা ১৫ শতক জমিও কিনেছেন। ২০১৩ সালে রংপুর বিভাগীয় পর্যায়ে ‘জয়িতা’ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি, যেটি ছিল সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অবদানের স্বীকৃতি।

ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের পেশা কৃষিকাজ। ধান প্রধান ফসল। তবে গ্রামটিতে আলু, ভুট্টা, গম, সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ হয়। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পালন করা হয় গবাদিপশু। পুকুরে চাষ করা হয় মাছ। গ্রামের মানুষ জানান, শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের অনেকে কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, খামার ও কৃষিকাজ করেন।

ডাঙ্গাপাড়া গ্রাম সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) অধীনে। এই ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আজম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামটিতে না খেয়ে থাকার কষ্ট এখন আর নেই। বাড়িতে বাড়িতে পাকা ঘর গড়ে উঠছে। যে বাড়িতে কুঁড়েঘর ছিল, সেটা হয়েছে টিনের ছাউনির। এই কৃতিত্ব সাদেকার, পাশাপাশি সরকারকেও দিতে হবে।

গ্রামের গৃহবধূ ইয়াছমিনা বেগম, রোজিনা বেগম, রেখা মনিসহ আরও কয়েকজন তাঁদের অভাব দূর করার গল্প বললেন। রেখা বললেন, একসময় তাঁরও খড়ের ছাউনির ঘর ছিল। এখন টিনের ঘর হয়েছে। চাষাবাদের জন্য ৩০ শতক জমি বন্ধক নিয়েছেন। আছে গরু ও ছাগল। তিনি আরও জানান, সমিতিতে জমানো টাকার ভাগ বাবদ ৫ বছর আগে ২০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন তিনি। তা দিয়ে হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেন। হাঁস-মুরগির আয় দিয়ে পরে গরু কেনেন।

দারিদ্র্য কমলে সামাজিক নানা দিক দিয়ে একটি জনপদ এগিয়ে যায়। সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য রোকেয়া বেগম জানালেন সেই কথাই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে এখন নারী নির্যাতনের অভিযোগ নেই বললেই চলে। সমিতির সদস্যদের ভয়ে কেউ বাল্যবিবাহ দেওয়ার সাহস করেন না। অসচ্ছলদের প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়েতেও সহায়তা করে ওই সমিতি।

ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে অপরাধ কম—এই দাবি কতটুকু সত্যি তা জানতে যোগাযোগ করা হয় সয়ার ইউনিয়ন বিট পুলিশ কর্মকর্তা আজমল হোসেন ও সহকারী কর্মকর্তা রায়হান হোসেনের সঙ্গে। তাঁরা দুজনেই বলেন, ডাঙ্গাপাড়ায় অপরাধের কথা শোনা যায় না। মাদক ব্যবসার অভিযোগও নেই।

ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের পূর্ব দিকে সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়। পরিষদের একটি কক্ষে চালু আছে ডিজিটাল সেন্টার। সরকার দেশের প্রায় সব কটি ইউনিয়নে এই সেন্টার চালু করেছে।

বাদ যায়নি সয়ার ইউনিয়নও। এই ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারের ডিজিটাল উদ্যোক্তা সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে জানান, ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যুসনদ, ভূমি পরিষেবা, পাসপোর্ট ও ভিসার আবেদন, হজ নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও চাকরির আবেদন, মোবাইল ব্যাংকিংসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়।

ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে ফেরার আগে সাদেকা আক্তারের কাছে জানতে চাওয়া হলো, বাংলাদেশের বহু মানুষ এখনো দরিদ্র (সরকারি হিসাবে হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ)। বহু নারী স্বাবলম্বী নন। তাঁদের উদ্দেশে কী বলবেন। তিনি বললেন, নিজের জীবন গোছাতে নিজেকে আগে উদ্যোগী হতে হবে।