যৌতুক সম্পর্কে আইন কী বলে

প্রতীকী ছবি

যৌতুক কী?

যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়ার চর্চা হয়ে আসছে। যৌতুকের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে, তার ইতিহাস স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হয়, যে সময় সমাজে নারীর কোনো মূল্য ছিল না, পণ্যের মতো তাঁদের কেনাবেচা করা হতো, এমনকি বিয়ের সময় ছেলেপক্ষের কাছে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করে বিয়ে দেওয়া হতো, এ রকম সময়েই যৌতুকের আবির্ভাব ঘটে। যৌতুক বন্ধে বাংলাদেশে ‘যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮’ রয়েছে। সেখানে যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যৌতুক হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের কাছে দাবি করা অর্থসামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ। এ দাবি বিয়ের আগে, পরে বা বিয়ের সময়—যখনই হোক না কেন, তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে। তবে মুসলমানদের ক্ষেত্রে দেনমোহর যৌতুক বলে গণ্য হবে না। আবার বিয়ের আসরে অতিথিরা নিজের ইচ্ছায় উপহার প্রদান করলেও তা যৌতুক নয়।

যৌতুকের মামলায় বিবাহ বলবৎ থাকতে হবে

অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদের পর দেনমোহরের মামলার পাশাপাশি যৌতুকের মামলা করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু যৌতুকের মামলা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবাহ বলবৎ থাকতে হবে। বিচ্ছেদের পর অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে বাধা নেই। তবে যৌতুকের মামলার জন্য বিবাহ বলবৎ থাকা জরুরি। এ ব্যাপারে মোসাম্মৎ উম্মে কুলসুম জিনাল আরা বনাম শাহিদুল এবং অন্যান্য ২ এলএনজে (২০১৩) এইচসিডি ২৩৫ মামলায় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(খ) ধারার অধীনে করা হয়; অর্থাৎ যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম করা হয়েছে বলে মামলাটি করা হয়। আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়, মামলাটি করার আগে পক্ষদ্বয়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে এবং বিচ্ছেদ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। মামলায় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, বিচ্ছেদের পর যৌতুকের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

যৌতুকের মামলা কি শুধু বরপক্ষের বিরুদ্ধে হয়?

যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ২(খ) ধারায় যৌতুকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা থেকে প্রতীয়মান হয়, যৌতুক যে সর্বদা বরপক্ষ দাবি করবে, তা নয়। কনেপক্ষ বিয়ের শর্ত হিসেবে দেনমোহর ব্যতীত অন্যান্য অর্থসম্পদ দাবি করলেও তা যৌতুক এবং এর জন্য প্রচলিত আইনের অধীনে আদালতে মামলা করা যায়। আইনের এ ধারার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু মামলা দেখা গেছে, যেখানে স্বামী তাঁর স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা করেছেন। মামলার ফলে স্ত্রী ও তাঁর আত্মীয়স্বজন আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্তও হয়েছেন। সুতরাং যেকোনো পক্ষই বিয়ের শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত ধনসম্পদ দাবি করলে তা যৌতুক হবে এবং যৌতুক দাবি করায় অপরাধী বলে গণ্য হবেন।

যৌতুকের সাজা

যেহেতু যৌতুক দেওয়া-নেওয়া ও দাবি করা গুরুতর অপরাধ, সেহেতু আইনে এ অপরাধের জন্য সাজা বা দণ্ডের উল্লেখ আছে। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ও ৪ ধারা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে যৌতুক দাবি, প্রদান ও গ্রহণ করার দণ্ড হচ্ছে অনধিক পাঁচ (৫) বছর; কিন্তু অন্যূন এক (১) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। যে ব্যক্তি যৌতুক দেওয়া বা গ্রহণ করার ব্যাপারে সহায়তা করবেন, তিনিও একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

যৌতুকের জন্য নির্যাতনের প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্র বনাম সানোয়ার হোসেন জোয়ারদার, ২ এলএনজে (২০১৩) এইচসিডি ৪৬২ মামলায় আদালত মতামত প্রদান করেন, আসামি যে খুনের সঙ্গে জড়িত, তার পুরোপুরি নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সেই খুন যদি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ধারার অধীনে হয়েছে বলে প্রতীয়মান না হয়, তাহলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার অধীনে আসামির বিচারকার্য পরিচালিত হবে এবং দণ্ডিত করা যাবে। কোন ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ ধারার অধীনে মামলা করা যাবে, তা বিশ্লেষণের জন্য আরেকটি মামলা উল্লেখ করা যায়। রাষ্ট্র বনাম এ আউয়াল ৪ এলএনজে (২০১৫) এইচসিডি ১৯০ মামলায় বলা হয়, স্বামী বা শ্বশুরবাড়ি কর্তৃক যৌতুকের দাবিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ধারার অধীনে মামলা করার পূর্বশর্ত হিসেবে ধরা হবে; অর্থাৎ ১১(ক) ধারায় মামলা করার জন্য যৌতুকের দাবিই যথেষ্ট।

যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও মৃত্যু ঘটানোর শাস্তি

প্রতিদিনের পত্রিকা খুললে প্রায়ই শিরোনামে দেখা যায় যে ‘যৌতুক দিতে না পারায় কনের মৃত্যু’ বা ‘যৌতুকের চাহিদা মেটাতে না পারায় নববধূ খুন’। এ থেকে স্পষ্ট, আমাদের সমাজে যৌতুক এমন চরম আকার ধারণ করেছে যে এর দাবি মেটাতে অস্বীকার করলে নির্যাতন থেকে শুরু করে খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে যায়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০ (সংশোধিত)-এর ১১ ধারায় বলা হয়েছে যে যদি যৌতুকের কারণে কোনো নারীর মৃত্যু ঘটানো হয়, তাহলে তার জন্য সাজা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে তার জন্য শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। একই ধারায় বলা হয়েছে, যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম হলে দোষী ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১২ বছর; কিন্তু অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ১১ ধারাতে আরও বলা হয়েছে যে যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম হলে দোষী ব্যক্তি অনধিক তিন বছর, কিন্তু অন্যূন এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডেও অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ ধারার অধীনে সাজার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে যে মৃত্যু, সাধারণ জখম ও মারাত্মক জখম যৌতুক প্রদানে অস্বীকৃতির কারণে ঘটানো হয়েছে। যৌতুক-সংক্রান্ত ঘটনা ব্যতীত অন্য কোনো কারণে ঘটানো হলে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির অধীনে তার বিচার হবে।

প্রতীকী ছবি

একটি মামলার উদাহরণ

মামলাটি শেরপুর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করা হয়। পরবর্তী সময়ে তা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ঘটনাটি এ রকম ছিল, মামলার প্রধান আসামি ও হত্যাকাণ্ডের শিকার ভুক্তভোগী নারী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। বিয়ের পর থেকেই আসামি যৌতুক হিসেবে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে আসছিলেন, যা ভুক্তভোগীর পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ জন্য ভুক্তভোগী প্রতিনিয়ত আসামির দ্বারা অত্যাচারের শিকার হতেন। একদিন প্রচণ্ড রকম বিবাদের একপর্যায়ে মামলার প্রধান আসামি ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মিলে ভুক্তভোগীকে মারাত্মক জখম করেন। ঘটনার পরদিন ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, প্রধান আসামি ও ভুক্তভোগীর সংসারে চার সন্তান ছিল এবং ঘটনার সময় ভুক্তভোগী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। সেই অবস্থায়ই তাঁকে নির্যাতন করে মৃত্যু ঘটানো হয়। ঘটনার পর মৃত ভুক্তভোগীর আত্মীয়রা জিডি করেন এবং তাঁর ছোট ভাই আদালতে অভিযোগ করেন।

মামলার উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ট্রাইব্যুনাল আসামিদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ও ৩০ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তা উচ্চ আদালতে পাঠানো হলে ওই আইনের ধারা থেকে পরিবর্তন করে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে সাজা দেওয়া হয়। ফলে আসামিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে এবং সেই সঙ্গে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হন। পরবর্তী সময়ে মামলাকারী কর্তৃক আপিল করা হলে আপিল বিভাগ মত দেন যে বিশেষ আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে সাধারণ আইনের অধীনে নিয়ে এসে সাজা পরিবর্তন করার জন্য উচ্চ আদালত অধিকারভুক্ত নন।

প্রতীকী ছবি

যৌতুক নিয়ে মিথ্যা মামলার সাজা

একদিকে যেমন যৌতুককে কেন্দ্র করে নারী নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে আবার যৌতুক-সংক্রান্ত মিথ্যা মামলার ঘটনাও ঘটছে। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে যৌতুক নিরোধ আইনটিকে প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে কিছু ব্যক্তি মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন, যা ব্যাপক হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো আইনানুগ কারণ নেই জেনেও যদি কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা বা অভিযোগ করেন, তাহলে সেই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আবার ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির অধীনেও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলা করলে তার জন্য শাস্তি হবে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। তবে মামলার ধরন যদি এমন হয়, যার জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সাত বছরের অধিক কারাদণ্ড হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তাহলে মিথ্যা মামলাকারীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড হবে। যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌতুকের অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে এ ধারার অধীনে মামলা করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে পারবেন।

নাজিয়া আমিন আইনজীবী