শিক্ষকদের বিভিন্ন পদ থেকে পদত্যাগ
কেউ বলছেন ভাগ–বাঁটোয়ারার বিষয়, কেউ স্বার্থের দ্বন্দ্ব: চবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিভিন্ন পদ থেকে শিক্ষকদের একের পর এক পদত্যাগ করছেন। গত রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, প্রাধ্যক্ষ, সহকারী প্রক্টরসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ থেকে ১৬ শিক্ষক পদত্যাগ করেন। এরপর গতকাল সোমবার পদত্যাগ করেন আরও তিনজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে নিয়োগ নিয়ে উপাচার্য শিরীন আখতারের সঙ্গে প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়ার দ্বন্দ্ব থেকে এক পক্ষের শিক্ষকেরা এভাবে পদ ছাড়ছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
লাগাতার পদত্যাগের ঘটনায় প্রশাসনেও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মোশাররফ শাহ।
প্রথম আলো: লাগাতার পদত্যাগের কারণে প্রশাসনে টালামাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষকেরা। আপনার বক্তব্য কী?
মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী: প্রশাসনের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম চলে আসছে। এ অনিয়মের বিভিন্ন রকম সুযোগ–সুবিধা যাঁরা পেয়ে আসছেন, তাঁদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে উপাচার্যের বিভিন্ন রকম অনিয়মতান্ত্রিক কাজের সঙ্গে যাঁরা জড়িয়েছিলেন...অর্থাৎ, এতে মনে হয় বিভিন্ন রকম সুযোগ–সুবিধা যাঁরা পেয়ে আসছিলেন, তাঁরা আর পাচ্ছেন না অথবা তাঁদের মধ্যে নতুন ধরনের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। এ চাহিদাগুলো উপাচার্য কিংবা প্রশাসন থেকে পাওয়ার সুযোগ ছিল না।
প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। এর প্রভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম কতটা ব্যাহত হবে?
মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী: প্রশাসনিক কাজে কতটা ব্যাহত হবে, তা জানি না। কারণ, উপাচার্য অন্যদের নিয়োগ দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। তবে এ ধরনের ঘটনা বাইরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমকে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। উপাচার্য যদিও নির্বিকার ভাব দেখাচ্ছেন, কিন্তু প্রশাসনে একধরনের অস্থিরতা কাজ করছে।
প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া কী?
মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী: শিক্ষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ বলছেন, এটা লেনদেন, ভাগ–বাঁটোয়ারার বিষয়, আবার কেউ বলছেন, স্বার্থের দ্বন্দ্ব। তবে সবাই কথা বলতে চান না। কারণ, কথা বললে কখন কী হয়ে যায়—এ ভীতিটা কাজ করে।
প্রথম আলো: বর্তমান উপাচার্যের আমলে বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে একের পর এক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদত্যাগের পেছনেও নিয়োগ নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল...
মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী: বিশ্ববিদ্যালয় চলে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী। কিন্ত এখানে এটি ধারণ করা হয় না। উপাচার্যকে বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে বলা হয়েছে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোন বিভাগে কতজন শিক্ষকের প্রয়োজন হবে, সেটি নির্ধারণ করবে বিভাগের প্ল্যানিং কমিটি। কিন্তু এ কমিটির বাইরে গিয়ে বিজ্ঞাপিত পদের বেশি শিক্ষক নেওয়া যাবে—এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তাহলে বুঝতে হবে, এর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।
প্রথম আলো: নিয়োগের অর্থ লেনদেন নিয়ে ফোনালাপ ফাঁস হয়েছিল। এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত কি হয়েছিল?
মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী: বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে বলে আমি জানি। এ তদন্ত নিয়েও অনেক ধরনের কথা রয়েছে। তদন্তে যথাযথ পক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত।
প্রথম আলো: শিক্ষকদের মধ্যে এত দ্বন্দ্বের কারণ কী?
মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী: এর কারণ হচ্ছে, উপাচার্য তাঁর ইচ্ছামতো প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজগুলো করতে চান। এ কারণে তিনি মনে কারণে তাঁর নির্দেশে সবকিছু হবে। অধ্যাদেশ মানার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা সন্দেহজনক। এমনভাবে তিনি নিয়োগের প্রক্রিয়াটি সাজিয়েছেন, যেন তাঁর ইচ্ছাটি কার্যকর হয়।
প্রথম আলো: পদত্যাগের পর উপাচার্য তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, রবিউল হাসান ভূঁইয়া বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছেন। রবিউল হাসান ভূঁইয়ার ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা ছিল। এ বিষয়টি কীভাবে দেখছেন।
মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী: উপাচার্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মন্তব্য করেছেন, যাঁরা পদত্যাগ করেছেন, তাঁদের মধু খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, প্রক্টর নিয়োগ দিয়েছে এসব কথা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। কারণ, নিয়োগে স্বাক্ষর কে করেছে? রবিউল হাসান ভূঁইয়ার নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা আছে? এসব সিদ্ধান্ত তো উপাচার্য নেন, তাঁর সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু হয় না। এসব দায় উপাচার্যেরই, প্রক্টরের নয়।
প্রথম আলো: এসব ঘটনা শিক্ষার্থীদের কতটুকু প্রভাবিত করবে?
মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী: শিক্ষার্থীরা হয়তো প্রকাশ করে না। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ রয়েছে। কী হচ্ছে তাঁরাও সব জানে। শিক্ষার্থীদের ভাবছেন, যাঁরা আমাদের পড়াচ্ছেন, তাঁদের মধ্যেই যদি সমস্যা থাকে, তাহলে কাদের থেকে শিখব? কথায় আছে ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাও’। নিজের আচরণ ঠিক না করে তাঁরা কীভাবে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হবে। ছাত্ররা বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে সেসব কথা বলে না। কিন্তু তাঁদের মনে সেসব কথা আছে।
প্রথম আলো: শিক্ষক সমিতির বেশির ভাগ সদস্যের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব রয়েছে কী?
মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী: দূরত্ব নয়, শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের স্বার্থ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ যাতে কার্যকর থাকে, সেটি দেখে। উপাচার্য যদি অধ্যাদেশ মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন, তাহলে আমরা সব সময় তাঁর সঙ্গে আছি।
আমরা তাঁর বিরোধী নই, তাঁর সহযোগী। উপাচার্যকেও সেসব কথা বলেছি। তাঁকে বলেছি, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া। সে অধ্যাদেশকে আপনি বিভিন্ন ছলচাতুরির মাধ্যমে ভঙ্গ করে অনিয়মতান্ত্রকি যে কাজগুলো করছেন, সেটি কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। উপাচার্যের নিয়মমাফিক প্রতিটি কাজের সঙ্গে আমরা আছি।