নিজেদের ভাষা বাঁচানোর জন্য লড়াই করা ম্রো শিশুরা ঢাকায় আসছে
বান্দরবানের লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ে গাছ-বাঁশ-ছনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটি স্কুল। নাম তার ‘পাওমুম থারক্লা’। ম্রো ভাষায় যার অর্থ ‘ফুলের কলি ফোটাতে হবে’। এই স্কুলের শিশুরা কেউ কোনো দিন লামার বাইরেও যায়নি। অভিভাবকদের অবস্থাও প্রায় একই। পাহাড়ের আড়ালে থাকা এই শিশুরা এবার ঢাকায় আসছে নিজেদের গল্প বলতে—প্রথমবারের মতো।
২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের পাওমুম থারক্লা স্কুলে শিশুরা পড়ছে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। ১৭ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে ‘ফ্রম হিলস টু হোপ’ উৎসব। সেখানে অংশ নেবে এই স্কুলের ২৬ শিশুসহ ম্রো জনগোষ্ঠীর ৪০ জন। তাঁরা জানাবেন, পাহাড়ের জীবন, সংস্কৃতি, স্বপ্ন আর সংগ্রামের কথা। এই শিশুদের চোখে ঢাকা শহর দেখবে এক অন্য রকম পৃথিবী। উৎসবে পাহাড়ের শিশুদের স্বপ্নগুলো যেন ডানা মেলতে পারে, সে আহ্বানও থাকবে।
ঢাকায় আসার অপেক্ষা
ফ্রম হিলস টু হোপ উৎসবে যোগ দিতে ঢাকায় আসার উত্তেজনায় দিন কাটাচ্ছে শিশুরা। কেউ পুঁতির মালা গেঁথে চলছে, কেউ ছবি আঁকছে। তারা চায়, ঢাকার মানুষদের হাতে উপহার হিসেবে কিছু একটা তুলে দিতে। বড়রা তৈরি করছেন ঐতিহ্যবাহী নকশার কম্বল, বাঁশের কাজসহ নানা হস্তশিল্প। প্রদর্শনীতে এগুলো থাকবে, বিক্রিও হবে।
২০১৬ সালে তিনজন শিশু নিয়ে শুরু হওয়া স্কুলটিতে এখন পড়ছে ৬৮ জন ম্রো শিশু। ৩০ জন থাকে হোস্টেলে, যা বান্দরবান জেলা পরিষদের সহায়তায় তৈরি হয়েছে। চারজন শিক্ষক আছেন; আর একজন বাবুর্চি আছেন শিশুদের খাবারের দায়িত্বে। স্কুলটিতে শিশুরা নিজের ভাষা শেখার পাশাপাশি বাংলা, গণিত ও ইংরেজি শেখে।
এ ছাড়া উৎসবে থাকবে শিল্পকর্ম, ফটোগ্রাফি, নাচ-গান, থিয়েটার, প্লুং বাঁশির সুর, এমনকি ম্রো খাবারের স্বাদও।
যেভাবে শুরু হলো পাওমুম থারক্লা
এই স্কুলের শুরুটা হয়েছিল ১০ বছর আগে। বর্তমানে ঢাকার একটি ক্রিয়েটিভ এজেন্সির জ্যেষ্ঠ কপি রাইটার শাহারিয়ার পারভেজ তখন শিক্ষার্থী। ঘুরতে গিয়ে পরিচিত হন লামার পাহাড়বাসীর সঙ্গে। জানতে পারেন, সেখানকার দুর্গম পাহাড়ের শিশুরা স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। সেখানেই নতুন এই ভাবনার জন্ম হয় তাঁর মনে।
এখন পর্যন্ত ঢাকায় স্বেচ্ছাসেবকসহ ৫০ জনের ১০ দিনের খাবার বাবদ প্রায় দেড় লাখ টাকার ঘাটতি আছে। তবে যে সময় হাতে আছে, তাতে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা এগিয়ে আসবে।শাহারিয়ার পারভেজ, পাওমুম থারক্লা স্কুলের সহপ্রতিষ্ঠাতা
মানুষের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকে পাড়া কার্বারি চংকত ম্রোর বাড়িতে সান্ধ্য ক্লাস দিয়ে এই স্কুলের যাত্রা শুরু করেন শাহারিয়ার। কিছুদিন পর চংকত ম্রো স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পাহাড় অনুদান দেন। পরে শাহারিয়ারের সঙ্গে যুক্ত হন লামার চেয়ারম্যানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উথোয়াইয়ই মারমা।
২০১৬ সালে তিনজন শিশু নিয়ে শুরু হওয়া স্কুলটিতে এখন পড়ছে ৬৮ জন ম্রো শিশু। ৩০ জন থাকে হোস্টেলে, যা বান্দরবান জেলা পরিষদের সহায়তায় তৈরি হয়েছে। চারজন শিক্ষক আছেন; আর একজন বাবুর্চি রয়েছেন শিশুদের খাবারের দায়িত্বে। স্কুলটিতে শিশুরা নিজের ভাষা শেখার পাশাপাশি বাংলা, গণিত ও ইংরেজি শেখে।
স্কুলটির উদ্যোক্তারা বলেন, লামার দুর্গম এলাকার শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পায় না। পাওমুম থারক্লার শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই পরিবারের প্রথম সন্তান, যারা স্কুলে যাচ্ছে। এখানে শিশুরা বিনা মূল্যে পড়াশোনা করে। তবে হোস্টেলে থাকার জন্য বছরে ৯ হাজার টাকা নেওয়া হয়। টাকা দিতে না পারলে পরিবারের পক্ষ থেকে চাল-ডাল-সবজি নেওয়া হয়।
পরিবেশবান্ধব স্কুলঘর
বুয়েটের স্থাপত্যবিদ সায়নসুর ও কৌশিক কুমারের নকশায় ২০২১ সালে তৈরি হয় পাওমুম থারক্লার জন্য পরিবেশবান্ধব দোতলা স্কুলঘর। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা এসে ম্রো শিশুদের ছবি আঁকা শেখান। তাদের আঁকা ছবির টাকাও স্কুলের তহবিলে যোগ হয়। এ ছাড়া ঢাকায় ‘পাওমুমের জন্য গান’ শিরোনামে কনসার্টের আয়ের টাকাও এসেছে স্কুলে।
এ স্কুলটি ভর করে আছে পাহাড়ি মানুষের সহায়তায়—কেউ পরামর্শ দেন, কেউ শ্রম দেন, কেউ দেন সামান্য সামর্থ্যের সাহায্য।
ঢাকায় যেতেও লাগবে সহায়তা
স্কুলটির উদ্যোক্তারা বলেন, ঢাকায় উৎসবে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে জায়গা মিলেছে বিনা মূল্যে। কেউ যাতায়াতের খরচ দিয়েছেন, কেউ ঢাকায় থাকার জায়গা করে দিয়েছেন, আবার কেউ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন।
স্কুলের সহপ্রতিষ্ঠাতা শাহারিয়ার পারভেজ বলেন, এখন পর্যন্ত ঢাকায় স্বেচ্ছাসেবীসহ ৫০ জনের ১০ দিনের খাবার বাবদ প্রায় দেড় লাখ টাকার ঘাটতি আছে। তবে যে সময় হাতে আছে, তাতে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা এগিয়ে আসবে বলে আশাবাদী তিনি।
পাহাড়ের ভাষা বাঁচানোর লড়াই
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের (কেএসআই) তথ্য বলছে, বান্দরবান জেলার ৭টি উপজেলায় সরকারিভাবে স্বীকৃত ১১টি পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী আছে। ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, জনসংখ্যার বিচারে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ম্রো জনগোষ্ঠী। সংখ্যা ৫১ হাজার ৪৪৮; কিন্তু তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
ম্রো ভাষা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের ভাষায় শিক্ষা শুরু করলে শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ে। গত ১০ বছরে দেখেছি, সুযোগ পেলে পাহাড়ি শিশুরা চমৎকার আঁকে, গায়, নাটক করে ও গল্প বলে। পাওমুম থারক্লা এসব হারিয়ে যাওয়ার পথটা আটকাতে চায়।উথোয়াইয়ই মারমা, পাওমুম থারক্লা স্কুলের সহপ্রতিষ্ঠাতা
উথোয়াইয়ই মারমা বলেন, ‘ম্রো ভাষা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের ভাষায় শিক্ষা শুরু করলে শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ে। গত ১০ বছরে দেখেছি, সুযোগ পেলে পাহাড়ি শিশুরা চমৎকার আঁকে, গায়, নাটক করে ও গল্প বলে। পাওমুম থারক্লা এসব হারিয়ে যাওয়ার পথটা আটকাতে চায়।’
ঢাকায় এবারের উৎসব আয়োজন নিয়ে উথোয়াইয়ই মারমা বলেন, এবারের উৎসবে অংশ নিয়ে শিশুদের চোখ দিয়ে শিশুরা নতুন দুনিয়া দেখবে। তারা জানবে, ঢাকা শহরেও এই শিশুদের গল্পগুলো জায়গা পেতে পারে।
স্বপ্ন থেমে না যাওয়ার অনুরোধ
করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে স্কুলের শিক্ষার্থী বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২০ জনে। করোনায় অনেক শিশু স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া জুমচাষে মা–বাবার সঙ্গে কাজ করতে হয় বলেও অনেক শিশু ঝরে পড়ে। অনেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আর চালিয়ে যেতে পারে না।
উথোয়াইয়ই মারমা বলেন, এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে এখন অন্য স্কুল বা কলেজে পড়ছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২।
শাহারিয়ার পারভেজ বলেন, ঢাকার পাওমুম উৎসবে স্কুলটির ১০ বছরের গল্প শুনবেন শহুরে মানুষেরা। স্কুলটি সরকারিভাবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান করার প্রক্রিয়া চলছে। স্কুলটিকে মাধ্যমিক স্কুল হিসেবে গড়ে তোলা, হোস্টেলের উন্নয়ন, খাবার পানি, সোলারের ব্যবস্থা, মেডিকেল ক্যাম্পসহ নানা আয়োজনেও মানুষের সহায়তা প্রয়োজন।
উথোয়াইয়ই মারমা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার কাছে বিনীত অনুরোধ জানাই, যদি পারেন পাশে থাকুন। আপনাদের একেকটি ছোট সহায়তাই আমাদের বাচ্চাদের পথচলা সহজ করবে।’