বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত হয়ে দুর্নীতিবাজ ও কালোবাজারিদের প্রতিহত করি: প্রধান বিচারপতি

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আজ সোমবার সুপ্রিম কোর্ট আলোচনা সভার আয়োজন করে
ছবি: প্রথম আলো

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে দীক্ষিত হয়ে দুর্নীতিবাজ ও কালোবাজারিদের প্রতিহত করার পাশাপাশি তাদের সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। জাতীয় শোক দিবস–২০২২ উপলক্ষে আজ সোমবার সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত আলোচনা সভা, দোয়া ও রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এ আহ্বান জানান।

সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘এই শোকের দিনে আমার মনে পড়ে যায়, বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বিভিন্ন ভাষণে দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি ও কালোবাজারিদের দেশ ও জাতির শত্রু হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন। আসুন, আমরা এই মহান নেতার আদর্শে দীক্ষিত হয়ে দুর্নীতিবাজ ও কালোবাজারিদের প্রতিহত করি, সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যান করি। ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করি। দেশের মানুষ যেন স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে ন্যায়বিচার পায়, সে লক্ষ্যে কাজ করি। এই শপথ গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানাই।’

প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আলোচনায় এসেছে বঙ্গবন্ধু শাসক হিসেবে কেমন ছিলেন। আমরা আইন অঙ্গনের লোক—এটি আমরা দেখি খুব কাছ থেকে। পাকিস্তান ৯ বছরে শাসনতন্ত্র দিতে পারেনি, ৯ মাসে বঙ্গবন্ধু আমাদের শাসনতন্ত্র দিয়েছেন। শুধু ১৯৭২ সালে শাসনতন্ত্র ছাড়াও প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডার হয়েছে ১৫৬টি। এর একটিরও দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলন সাংঘর্ষিক ঘোষণা করতে পারেননি আদালত। ১৫৬টি প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডার পরিপূর্ণ আইন, এক বছরে তৈরি করেছেন। এটি কি প্রমাণ করে যে বঙ্গবন্ধু পরিশ্রম করেননি? একটি আইন তৈরি করতে আমাদের কতবার ভাবতে হয়, কত পড়াশোনা করতে হয়। ওই সময় প্রতি দুই দিনে একটি করে আইন হয়েছে। এরপরও যদি কেউ মনে করেন বঙ্গবন্ধু পরিশ্রম করেননি, প্রশ্ন তোলেন...। ওই সময় বঙ্গবন্ধু কী করেছিলেন, ভালো করে দেখে বুঝে তারপরে সমালোচনা করবেন। নইলে তাঁর প্রতি অবিচার হবে, সমস্ত জাতির প্রতি অবিচার হবে।’

‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা যাঁরা সমালোচনা করবেন, যাঁরা জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে সমালোচনা করবেন, তাঁদেরকে আমি বলব, ১৯৭১ সালে আপনারা কোথায় ছিলেন? আমরা দেখেছি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ হয়েছিল। জয় বাংলা বলেই বুলেটের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা, দেশের মানুষ নিজের বুক পেতে দিয়েছিলেন এবং দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন জয় বাংলা স্লোগান বলতে যদি কারও লজ্জা হয়, আমি তো মনে করি স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় যে ১–২ পার্সেন্ট যারা জয় বাংলার বিরোধিতা করেছেন, যাদের লজ্জা হয় তারা হচ্ছে তাদের ভেতরকার লোক।’

আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, বঙ্গবন্ধু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ছিলেন বদ্ধপরিকর। তিনি এ দেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন করেছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক—সব ধরনের মুক্তি তিনি চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে যত দ্রুত মানুষের কাছে বিচার পৌঁছে দেওয়া যাবে, সেটিই হবে মানুষের জন্য মঙ্গল। আসুন, আমরা যারা আইন বিভাগে কাজ করছি, আইনের কাজ করি—এই বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা কাজ করি, তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।’

আপিল বিভাগের বিচারপতি বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে সত্যিকার সোনার বাংলায় রূপায়িত করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রত্যেকের কাজ হবে যার যার নিজের কাজ আন্তরিকভাবে করা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ–উপলব্ধি হৃদয়ে ধারণ করা। প্রত্যেককে তাদের নিজের কাজ আন্তরিকভাবে করার আহ্বান জানান তিনি।

আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, শুধু রিডিং পড়ার মতো সংবিধান পড়লে হবে না। সংবিধান দ্রুত পঠনের বিষয় নয়। আত্মস্থ করার বিষয়। সংবিধানকে আত্মস্থ করতে হবে, স্বাধীনতার সংগ্রামের ও দীর্ঘদিনের সংগ্রামের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় দুটি শব্দ খুব বেশি বলতেন—আসুন, আত্মসমালোচনা করুন, আত্মশুদ্ধি হোক। এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষণে দেখবেন, বঙ্গবন্ধুর বিচার বিভাগের কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল। নিজে দীর্ঘদিন কারাগারে থেকেছেন, কারাগারের মানুষ, বিচারপ্রার্থী মানুষ কীভাবে হয়রানি হয়েছে, তিনি দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানিয়েছিলেন বিচারক ও আইনজীবীদের কাছে যে দেশের মানুষকে কীভাবে দ্রুত বিচার দেওয়া যায়। সেই দায়িত্ব আমাদের কাঁধে—আসুন আমরা সেই দায়িত্ব পালন করি। যে যেখানে আছি, নিজেরা আত্মসমালোচনা করি ও আত্মশুদ্ধি করার চেষ্টা করি। বঙ্গবন্ধু যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন বিচার বিভাগ সম্পর্কে মানুষের কাছে সহজে ও দ্রুত বিচার পৌঁছে দেওয়ার জন্য—এই দায়িত্বের কিছু হলেও যদি পালন করি তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হবে।

সপরিবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে কমিশন গঠনের বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কাজ হচ্ছে। অচিরেই কমিশনের রূপরেখা জানা যাবে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পেছনের কুশীলবদের এখনো বিচার হয়নি। জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়নি। কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য, সেই মুখোশ উন্মোচন। তবে কোনো প্রতিশোধপরায়ণতার জন্য নয়। সঠিক সত্যটি মানুষের কাছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই কমিশন করা হবে। কারা এর পেছনে জড়িত ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কারা কাজ করেছে এবং কারা এই বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করেছিল। ষড়যন্ত্রে যারা জড়িত ছিল, তাদের মুখোশ উন্মোচন করে মানুষের কাছে তুলে ধরা হবে। মানুষ যাতে বুঝতে পেরে আজন্ম তাদের মীর জাফরের মতো ঘৃণা করে—সে ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করছি।’

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিষ্পন্ন হয়েছে। দোষীদের শাস্তি হয়েছে। কয়েকজন পালিয়ে আছেন, তাঁদেরও নিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করা যায়, তাঁদের ফিরিয়ে এনে সাজা নিশ্চিত করা হবে।

আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, বিচারপতি মো. হাবিবুল গনি ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (সার্বিক) মো. আবদুর রহমান। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় শোক দিবস পালন উপলক্ষে আলোচনা সভা শেষে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যসহ সব শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।