খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা হচ্ছে না

বিএনপির নেত্রীর বিদেশে চিকিৎসার আবেদনে ‘না’ বলেছে আইন মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্তকে মানবাধিকারবিরোধী ও রাজনৈতিক বলেছে বিএনপি।

খালেদা জিয়া

নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট যখন আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে যাওয়ার কথা বলছে, সে সময় খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি দেশের রাজনীতিতে নতুন ইস্যু হিসেবে সামনে এসেছে। এমন পটভূমিতে বিএনপির চেয়ারপারসনকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার আবেদনে ‘না’ বলে দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। গতকাল আইনগত মতামত দিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইন অনুযায়ী অনুমতি দেওয়ার সুযোগ সরকারের হাতে নেই।

বিএনপি এটিকে মানবাধিকারবিরোধী ও সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে বর্ণনা করেছে।

প্রায় দুই মাস ধরে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। লিভার সিরোসিসের কারণে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় মেডিকেল বোর্ড আবারও তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেয়। এর আগেও মেডিকেল বোর্ড কয়েকবার এই পরামর্শ দিয়েছে। এবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন গত ২৫ সেপ্টেম্বর।

খালেদা জিয়ার পরিবারের সেই আবেদন নাকচ করে আইনমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আইনগত মতামত গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এর ব্যাখ্যায় আইনমন্ত্রী সরকারের হাতে অনুমতি দেওয়ার সুযোগ না থাকার যে কথা বলেছেন, তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও আইনজীবীদের অনেকে। তাঁরা মনে করেন, সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেই খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে পারে।

তবে এখন আইনগত মতামত দেওয়ার আগেই গত কয়েক দিনে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী বিএনপি নেত্রীর বিদেশে চিকিৎসার অনুমতির প্রশ্নে আইনগত জটিলতাসহ নানা রকম বক্তব্য দিয়েছেন। বিএনপিও সরকারের পদত্যাগের তাদের এক দফা দাবির পাশাপাশি খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতির দাবি সামনে এনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এরই মাঝে দুদিন আগে ওয়াশিংটন সফরের সময় ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তাতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হলে এখন যে সাজা স্থগিত করে তাঁকে বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। আবার তাঁকে জেলে যেতে হবে, আদালতে যেতে হবে। আদালতের কাছ থেকে তাঁকে অনুমতি নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর সেই সাক্ষাৎকার গত রোববার বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সরকারের অবস্থান আগেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপর গতকাল আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে বিএনপি অভিযোগ করেছে। গতকাল রোববার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করে ওই অভিযোগ করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত মানবতাবিরোধী, বর্বর ও অবিচারের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।

দুর্নীতির দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দী ছিলেন তিনি। দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে ওই দুই শর্তে মুক্তি দিয়েছিল। এরপর দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয়। তবে বেশ কিছুদিন ধরে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি হয়েছে দাবি করে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেওয়ার দাবি করে আসছেন বিএনপির নেতারা।

আরও পড়ুন

আইনমন্ত্রী ব্যাখ্যায় যা বললেন

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেছেন, আইনগতভাবে অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ সরকারের হাতে নেই। সেই মতামতই আইন মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু কী কারণে অনুমতি দেওয়ার সুযোগ নেই, সে ব্যাপারে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে বিস্তারিত আইনি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন আইনমন্ত্রী।

আইনমন্ত্রী বলেন, প্রথম যে আবেদনটি ছিল, যা ২০২০ সালের মার্চে নিষ্পত্তি হয়, সেই আবেদনে বলা ছিল, খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ, তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা যেন করা হয়। তখন দুটি শর্তে তাঁর দণ্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এটি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা-১-এর ক্ষমতাবলে দেওয়া হয়েছিল। শর্তগুলো হলো, প্রথমত তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। সেই শর্তগুলো মেনে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত হন এবং বাসায় ফিরে যান। সেভাবেই সেই দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়। তবে প্রতি ছয় মাস বৃদ্ধি করা যাবে কি না, বিষয়টি উন্মুক্ত ছিল। এরপর সেই সময় ছয় মাস করে মোট আটবার বাড়ানো হয়েছে।

আইনে কেন সুযোগ নেই, সেই ব্যাখ্যা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় কোনো দরখাস্ত যদি একবার নিষ্পত্তি করা হয়, সেই নিষ্পত্তি করা দরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করার অবকাশ আইনে থাকে না। আমরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা ১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং সর্বশেষ উপধারা ৬ ব্যাখ্যা করে মতামত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। সেই মতামত হচ্ছে ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে যে দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে, সেটি অতীত ও শেষ হয়ে গেছে। এটি আর খোলার কোনো উপায় নেই।’

এ সময় একজন সাংবাদিক জানতে চান, এই অবস্থায় যদি খালেদা জিয়ার পরিবার তাঁকে বিদেশে পাঠাতে চায়, তাহলে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, তিনি বারবারই বলছেন, সেটি হলো তাঁকে ফৌজদারি ৪০১ ধারায় দুটি শর্তযুক্তভাবে যে আদেশবলে সাজা স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি বাতিল করে তারপর পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ থাকলে তা করা হবে।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপমহাদেশে ৪০১ ধারার ক্ষমতা যখন সরকার প্রয়োগ করে, তখন সেটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না বলে সিদ্ধান্ত আছে। প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেছেন, সেটি হচ্ছে এখন যে আদেশ আছে, সেটি যদি বাতিল করা হয়, বাতিল করে তাঁকে (খালেদা জিয়া) যদি আবার কারাগারে নেওয়া হয়, তাহলে আদালতে যেতে পারেন। বর্তমান অবস্থায় তিনি আদালতে যেতে পারেন বলে কোনো সুযোগ নেই।

তখন একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তাহলে সেই আদেশ বাতিল করা হবে কি না। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বাতিল করাটি অমানবিক হবে, বাতিল করব না।’

ভিন্নমত সাবেক একজন বিচারপতির

আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যা সঠিক নয়।’ এই বক্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এম এ মতিন বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে তাঁকে যে মুক্তি দেওয়া হয়, সেটি আদালত থেকে করা হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা ব্যবহার করে সরকার নির্বাহী আদেশে ওই ব্যবস্থা নিয়েছে। সেই ধারা অনুযায়ী সরকারই তার আদেশ বাতিল, সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারে। ফলে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার সুযোগ সরকারের হাতেই রয়েছে।

সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন উল্লেখ করেন, বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া এবং বিদেশ যেতে না পারার যে দুটি শর্তে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রাখা হয়েছে, সেই শর্ত দুটি ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার নিজেই প্রত্যাহার করে নিতে পারে। শর্ত না থাকলেই তাঁকে বিদেশে নেওয়া যেতে পারে।

এম এ মতিন মনে করেন, সরকার নির্বাহী আদেশেই সাজা অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে স্থগিত করা এবং এমনকি সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে আদালতে না গিয়েই জটিলতার সমাধান সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

যদিও এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নন আইনমন্ত্রী। তিনি তাঁদের ব্যাখ্যাকেই আইনগত দিক থেকে সঠিক বলে দাবি করেন।

‘রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের এই সিদ্ধান্ত’

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদন আইনগতভাবে বিবেচনা না করে, রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর অন্যতম আইনজীবী কায়সার কামাল। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের কাছে এই অভিযোগ করেন। কায়সার কামাল উল্লেখ করেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে রাজবন্দীদের মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা করানোর দৃষ্টান্ত রয়েছে।

বাংলাদেশে ৪৪ বছর আগে ১৯৭৯ সালে সাজাভোগের মধ্যে একজন রাজনীতিককে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। সেই ঘটনাটি ছিল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সামরিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত তৎকালীন অবিভক্ত জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবকে চিকিৎসার জন্য জার্মানি পাঠানো হয়েছিল। তিনি এখন জেএসডির সভাপতি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার ঘটনার পর নভেম্বরে সেনাবাহিনীতে পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান চলে। তখন জাসদের তৎপরতায় একটি অভ্যুত্থান হয়। কিন্তু সেই অভ্যুত্থানে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি ক্ষমতা নেওয়ার পর কর্নেল আবু তাহেরসহ জাসদের ১৭ জন নেতাকে সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করেছিলেন। এর একজন অভিযুক্ত হিসেবে সামরিক আদালতে আ স ম আবদুর রবের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। সেই সাজা ভোগ করার সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৭৯ সালের ১ মে আবদুর রবকে চিকিৎসার জন্য তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি পাঠানো হয়েছিল। এই ঘটনাকে এখন উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে।