কার্টুনিস্ট মোরশেদের আহ্বানে সাড়া দিলেন নানা বয়সী নারী–পুরুষ, দুই দিনে খাল পরিষ্কার

রামচন্দ্রপুর খাল, মোহাম্মাদিয়া হাউজিং লিমিটেড (রোড ২) মোহাম্মদপুর, ৩ সেপ্টেম্বর
ছবি: জাহিদুল করিম

মাসিক রম্য পত্রিকা ‘উন্মাদ’-এর সহকারী সম্পাদক কার্টুনিস্ট মোরশেদ মিশু। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় তিনি এখন প্রজেক্ট ‘খালে হবে’-এর জন্য আলোচিত। তিনি দেখিয়েছেন, কোনো কাজ করার জন্য শুধু ইচ্ছা থাকলে তা সম্ভব করা যায়। পাওয়া যায় অন্যদের আর্থিক সহযোগিতা। স্বেচ্ছাসেবকেরা এগিয়ে আসেন। আর এ কারণেই মাত্র দুই দিনে ময়লার স্তূপে পানি দেখা যায় না, এমন খালও পরিষ্কার করে ফেলা সম্ভব হয়েছে।

গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর—এ দুই দিনে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের রামচন্দ্রপুর খাল পরিষ্কার ও খালের ওপর তিনটি সেতু রং করার কাজটি করেছেন মোরশেদ মিশুসহ বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ। মা-বাবার হাত ধরে বাচ্চারা এসে রংতুলি হাতে তুলে নিয়েছে। খালের ময়লা পরিষ্কার করার কাজে যে তরুণ-তরুণীদের কোনো ধারণাই ছিল না, তাঁরা মাত্র দুই দিনেই কাজটি শেষ করেছেন।

গতকাল মঙ্গলবার কথা হয় মোরশেদ মিশুর সঙ্গে। বললেন, তাঁর জন্ম ঢাকায়। তাই ঢাকার প্রতি টানটা একটু বেশি। ঢাকার নোংরা খালসহ বিভিন্ন বিষয়ই মনকে বিষণ্ন করে তোলে। এখন উদ্যোগ নেওয়ার সামর্থ্য হয়েছে। আর ‘উন্মাদ’-এর সম্পাদক আহসান হাবিব একটি কথা বলেছিলেন, যা মাথায় ঢুকে আছে। তাঁর কথাটি ছিল—‘আগের আমলে যেভাবে আন্দোলনে কাজ হতো, এখন আর সেভাবে হবে না। আন্দোলনও করতে হবে ক্রিয়েটিভভাবে।’ মোরশেদ মিশু জানালেন, এবারের ‘খালে হবে’ প্রজেক্টেও সেতু রং করার কাজের উদ্বোধন করেন আহসান হাবিব।

মোরশেদ মিশু বলেন, কার্টুন ও আঁকাআঁকি একটি শক্তিশালী মাধ্যম। দেড় বছর আগে মাথায় আসা নোংরা দেয়াল ও আশপাশ পরিষ্কার করে রঙিন করে তোলার আইডিয়া (ধারণা) অবশেষে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু করেছেন। আগামী দুই বছরে ২০০ দেয়াল, নদী, খাল পরিষ্কারের উদ্যোগ নেবেন। আপাতত ‘খালে হবে’ প্রজেক্টের পর পাহাড়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। বললেন, মানুষ পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে স্মরণিকা কিনে আনে আর চিপসের প্যাকেট থেকে শুরু করে যত ময়লা সব পাহাড়ে ফেলে আসে।

রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের বাসিন্দা মোরশেদ মিশু। মোহাম্মদপুরের খাল কেন পরিষ্কার করতে গেলেন—এ প্রশ্নের উত্তরে মোরশেদ মিশু বলেন, সম্প্রতি কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা শহর ডুবে গেল। মানুষ মারা গেল। তখন থেকেই খাল পরিষ্কার করার বিষয়টি মাথায় ছিল। বন্ধু ফুয়াদ ইসলাম ফেসবুকে মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেডের ১ থেকে ৩ নম্বরের মধ্যে অবস্থিত খালটির একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। ফুয়াদ ইসলাম আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘কেউ দেখার নেই।’

রামচন্দ্রপুর খাল পরিষ্কারের উদ্যোগ নেন মোরশেদ মিশু
ছবি: সংগৃহীত

ভিডিওটি দেখার পর মোরশেদ মিশু ফেসবুকে খাল পরিষ্কারের বিষয়টি নিয়ে পোস্ট দেন। ৯৩ জন স্বেচ্ছাসেবক খাল পরিষ্কারে অংশ নেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফরম পূরণ করেন। স্বেচ্ছাসেবকদের খাওয়াসহ ময়লা পরিষ্কারের জন্য যন্ত্রপাতি কেনাসহ আনুষঙ্গিক খরচের বিষয়টি মাথায় আসে। কারা এ বিষয়ে সহায়তা করতে চান বা পারেন, তা নিয়ে পোস্ট দেন।

দেয়াল রঙিন করার প্রজেক্টটিতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ, অ্যাওয়ারনেস থ্রি সিক্সটি পাশে ছিল। এবারও খালে হবে প্রজেক্ট শুরুর আগে মোরশেদ মিশু বিভিন্ন সংগঠন সহায়তা করবে কি না, তা জানার চেষ্টা করেন। অনেকেই সহায়তা করতে রাজি হন। তবে শর্ত ছিল, তাঁদের লোগো ব্যবহার করতে হবে। মোরশেদ মিশু এ শর্তে রাজি হননি। তাই এবারও এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ, অ্যাওয়ারনেস থ্রি সিক্সটি এবং দেশ ও দেশের বাইরে থাকা মানুষের সহায়তায় খাল পরিষ্কারের কাজটি শেষ করেন। তহবিলে মোট জমা হয় ৮৮ হাজার ১০০ টাকা। দুই দিনে খাবার, নৌকাভাড়া, ডুবুরি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বকশিশসহ মোট খরচ হয় ৮৬ হাজার ৬০০ টাকা।

মোরশেদ মিশু ফেসবুকে মোট তহবিল ও খরচের সব খতিয়ান দিয়ে রেখেছেন। বললেন, মানুষের টাকা আছে। বিভিন্ন খাতে খরচও করতে চান। কিন্তু কাকে বা কোন কাজে টাকা দেবেন, সে টাকা কাজে লাগবে কি না, তা বিশ্বাস করতে পারেন না। তাই যেকোনো উদ্যোগে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা টিকিয়ে রাখতে পারলে অর্থ কোনো সমস্যা নয়।

খাল পরিষ্কারের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে মোরশেদ মিশু বলেন, সিটি করপোরেশনের পিকআপগুলোর বর্জ্য ধারণক্ষমতা এক হাজার কেজি। খালের এক কোনা থেকেই ছয় পিকআপ বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ কী পরিমাণ যে বর্জ্য, তা ধারণা করাও কঠিন ছিল। পরে ডুবুরিরা ব্রিজের নিচের অংশে যেসব পাইপ আছে, সেগুলো ফাঁকা করে ময়লা যাওয়ার রাস্তা করে দিলে বর্জ্য আলাদা করে না তুলে পানির স্রোতের সঙ্গে তা যাওয়ার রাস্তা করে দেওয়া হয়। বর্জ্য একদম শেষ পর্যায়ে যেখানে গিয়ে জমা হয়, সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলেন।

চলছে খাল পরিষ্কারের কাজ
ছবি: সংগৃহীত

ফুয়াদ ইসলামের পাশাপাশি মোরশেদ মিশু ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ সরকার এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। জানালেন, আসিফ আহমেদ সরকার পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজে লাগানোসহ এই উদ্যোগে সার্বিকভাবে সহায়তা করেন।

আসিফ আহমেদ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শেষ ওয়ার্ড হাজারীবাগ থেকে খালটি শুরু হয়েছে। পরে তা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড হয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে শেষ হয়েছে। খালটি একেক জায়গায় একেক নামে পরিচিত। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে খালটি রামচন্দ্রপুর খাল নামে পরিচিতি পেয়েছে। আগে খালটি ওয়াসার অধীন ছিল। দুই বছর আগে তা সিটি করপোরেশনের আওতায় আসে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খালটি পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন জটিলতায় তিন মাস ধরে খাল পরিষ্কারের কাজটি বন্ধ থাকায় খালে ময়লার স্তূপ বেশি জমে গিয়েছিল।

মোরশেদ মিশু ও স্বেচ্ছাসেবকেরা যেভাবে খালটি পরিষ্কারে এগিয়ে এসেছেন, সে জন্য তাঁদের সাধুবাদ জানান আসিফ আহমেদ সরকার। তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন এ কার্যক্রমে। বললেন, নষ্ট ফ্রিজ, কম্বল, তোশকসহ এমন কোনো জিনিস নেই যা মানুষ খালে ফেলেননি। খালের পাড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েও কাজ হয়নি। মানুষ বিবেকবান না হলে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা কঠিন।

খাল থেকে আবর্জনা সরাচ্ছেন এক ব্যক্তি
ছবি: সংগৃহীত

নিজের বাসাও খালপাড়ে উল্লেখ করে এই কাউন্সিলর জানালেন, তরুণ-তরুণীরা এত কষ্ট করে খালটি পরিষ্কার করলেন, তবে তারপর মানুষ আবার ময়লা ফেলা শুরু করেছে।
আবার ময়লা ফেলা প্রসঙ্গে মোরশেদ মিশু বলেন, খালটিতে মানুষ সোনাদানা, টাকাপয়সা, লাশ ছাড়া আর মনে হয় সব জিনিস ফেলেছেন। কোলবালিশ, হেলমেট, পলিথিন—কী ফেলেননি, তা-ই প্রশ্ন। এলাকাবাসীর সামনে খালটি পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন যদি আবার ময়লা না ফেলার কথা বলতে হয়, তা দুঃখজনক।

‘পাগলাটে’ দুই ভাই

মোরশেদ মিশুর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ রাজ্জাক। মা নীলুফা রাজ্জাক গৃহিণী। বোন রাজিয়া রাজ্জাক শিক্ষক। বড় ভাই কমান্ডার (নেভি অফিসার) আবদুল্লাহ আল মামুন। মেজ ভাই উদ্যোক্তা মাহিন আবদুল্লাহ। ভাই–বোনদের মধ্যে সবার ছোট মোরশেদ মিশু।
মোরশেদ মিশু বললেন, ‘আমি আর আমার মেজ ভাই মাহিন আবদুল্লাহ এই পাগলাটে কাজগুলো করি। কোনো সময় মেজ ভাইয়ের আইডিয়া থাকে, কোনো সময় আমার আইডিয়া থাকে। আমরা দুই ভাই–ই বিয়ে-সংসার করিনি। মা ফেসবুক ব্যবহার করা শুরু করেছেন। পোস্ট দিতে পারেন না, তবে বান্ধবীদের ছেলেদের এসব কর্মকাণ্ডের খবর জানান। মনে মনে খুশি হন, তা বুঝতে পারি। মুখে অবশ্য বলেন, তোরা যে কী করিস!’
মোরশেদ মিশু জানালেন, কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হলেও অনার্স শেষ করেননি। ২০১২ সাল থেকে আঁকাআঁকি ও ‘উন্মাদ’-এর সঙ্গে আছেন। মেজ ভাই পত্রিকাটি পড়ার অভ্যাস তৈরি করেছিলেন সেই ছোটবেলা থেকে।

খালের ওপর থাকা সেতুর রেলিং রং করছেন কয়েক তরুণ–তরুণী
ছবি: সংগৃহীত

করোনার সময় দুই ভাই মিলে ‘ভালোবাসার ডিব্বা’ নামে একটি কার্যক্রম শুরু করেন। তখন মানুষের আর্থিক সহায়তায় অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে তা মানুষের বাসায় বিনা মূল্যে পৌঁছে দেওয়া হতো। তখনো লাখ লাখ টাকার হিসাব সবাইকে জানানো হয়েছিল। এ ছাড়া মেজ ভাইয়ের তদারকিতে রোজায় রাস্তায় থাকা মানুষকে ইফতার করানো হয়। পাহাড়ধস, বন্যাসহ যেকোনো দুর্যোগেও দুই ভাই বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে মানুষকে সহায়তা করেন। আর এসব কার্যক্রমে যাতায়াত বা নিজেদের খরচ ছাড়া সব টাকাই মানুষের কাছ থেকে পাওয়া।