পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কাঁদলেন তাঁরা

হুইলচেয়ারে করে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে, ৬ মে
ছবি: দীপু মালাকার

রাজনীতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সদ্য প্রয়াত পঙ্কজ ভট্টাচার্যের আদর্শ ধারণ করে, এমন গান পরিবেশন তখন শেষ হয়েছে। ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখা পঙ্কজ ভট্টাচার্যের ছবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর সংগঠনেরও শ্রদ্ধা জানানো শেষ। এ সময় হুইলচেয়ারে চেপে এলেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। একটু দূর থেকে ছবির দিকে তাঁকিয়ে রইলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর তাঁকে ছবির আরও কাছাকাছি নেওয়া হলো। চুপ করে থাকা কামাল হোসেনের দুই চোখ ছলছল করছিল তখন।

কেবল কামাল হোসেন নন, পঙ্কজ ভট্টাচার্যের ছবির সামনে গিয়ে কাঁদতে দেখা গেল আরও অনেককে। অনেকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর ছবির সামনে।

গত ২৪ এপ্রিল পরলোকগমন করেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য। পরদিন হয় শেষকৃত্য। আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সামাজিক ক্রিয়া সম্পাদনে এক আয়োজন করা হয়। সেখানেই এমন দৃশ্য দেখা গেল। আজকের এ আয়োজনে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্যের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

স্মৃতিচারণা করে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘পঙ্কজদা ছিলেন অসাধারণ এক ব্যক্তি। যেখানেই কোনো সমস্যা হতো, জনগণের অধিকারের ওপর আঘাত হতো, তিনি একদম সামনে দাঁড়াতেন। মানুষের পক্ষে প্রতিবাদ করতেন। মানুষকে নিয়ে তাঁদের মুক্তির জন্য কাজ করে যেতেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় কোনো নেতা হননি যে সব ব্যাপারে এ রকম সক্রিয়।’

বেলা একটায় প্রদীপ প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সামাজিক ক্রিয়া সম্পাদনের এই আয়োজন। এরপর আধা ঘণ্টা ধরে সংগীত পরিবেশন হয়। সংগীতায়োজনের প্রথম গানটি করেন পঙ্কজ ভট্টাচার্যের শ্যালিকা বহ্নিশিখা দাশ পুরকায়স্থের মেয়ে নম্রতা মনস্বি বসু। এ সময় ছবি ও বিজন মিস্ত্রিও গান পরিবেশন করেন। গান শেষে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এরপর গণফোরাম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ঐক্য ন্যাপ, সমমনা প্রভৃতি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতা–কর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পঙ্কজদাকে নিয়ে বলার অনেক কিছুই আছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে আমরা তো বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছি। কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের সম্পর্কে বলা যায় যে তাঁরা কখনোই পথভ্রষ্ট হননি কিংবা এমন পথ বেছে নেননি শুধু নিজের সুবিধার জন্য। যত রকম ত্যাগ স্বীকার করতে হোক, কষ্ট নিতে হোক, সবকিছু মাথায় নিয়েই কিছু মানুষ তাঁদের নীতি–নৈতিকতা বজায় রেখে জীবন অতিবাহিত করেছেন। সেই দিক থেকে পঙ্কজদা একজন, যিনি একটা শুদ্ধ জীবন যাপন করে গেছেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি, সেটা আমাদের জন্য বিরাট পাওয়া।’

পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল
ছবি: প্রথম আলো

পঙ্কজ ভট্টাচার্য শেষ দিনগুলোতে ছিলেন বহ্নিশিখা দাশ পুরকায়স্থের কাছে। সম্পর্কে শ্যালিকা হলেও বহ্নিশিখাকে মেয়ে হিসেবেই দেখেছেন তিনি। বহ্নিশিখাও নিজেকে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মেয়ে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

আজকের এই আয়োজনের ব্যস্ততার এক ফাঁকে বহ্নিশিখা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি যে কয়েকটা দিন বেঁচে ছিলেন, প্রতিটি মুহূর্ত কাজ করেছেন। বই লিখেছেন, সমস্যার সমাধান করেছেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, তিনি কাজের মধ্য দিয়ে যাবেন। তিনি কাজের মধ্য দিয়েই গেছেন। তিনি চেয়েছেন, মানুষের জন্য কাজ করতে।

বহ্নিশিখা বলেন, ‘তিনি তাঁর জন্য কোনো আড়ম্বর করতে আমাকে মানা করেছিলেন। আমি আড়ম্বর করিনি। সত্যিকার অর্থে মানুষের যে রকম রূপ হওয়া উচিত—নির্লোভ, নিরহংকারী, মানবিক, সত্যনিষ্ঠ; তিনি তেমনই ছিলেন। তিনি নিজেকে কখনো বিক্রি করেননি।’

পঙ্কজ ভট্টাচার্যের ছবিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় তাঁর দল ঐক্য ন্যাপ। দলটির সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক বলেন, ‘পঙ্কজ ভট্টাচার্য একজন অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাঁর আদর্শ, উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা কাজ করে যাব। এর মধ্য দিয়েই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।’

পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন, গণফোরামের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ।