বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলার সময় সতর্ক থাকতে হবে: হাইকোর্ট

হাইকোর্ট ভবন
ফাইল ছবি

আদালত অবমাননার দায়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিবকে পাঁচ মাসের কারাদণ্ড ও দুই হাজার টাকা জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার এ রায় দেন।

রায়ে আদালত বলেছেন, বক্তব্য তাঁর (হাবিব) কি না, জানতে চাওয়া হলে তিনি শপথ নিয়ে বলেছেন ওই বক্তব্য তাঁর। হাবিবের দেওয়া বক্তব্যে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও ভাবমূর্তিকে খাটো করা হয়েছে। কোনো রায় বা আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ হতে পারেন। এ জন্য যথাযথ ফোরাম আছে। তার মতো রাজনীতিবিদ যেভাবে অভিব্যক্তি প্রকাশ করছেন, তাতে সাধারণ মানুষের কাছে কী বার্তা যাবে? তাঁর অভিব্যক্তিতে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তাঁর বক্তব্যে গুরুতর আদালত অবমাননা হয়েছে।

উচ্চ আদালতের বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানকে নিয়ে ‘অবমাননাকর বক্তব্যের’ প্রেক্ষাপটে গত ১৫ অক্টোবর হাবিবুরের প্রতি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার রুল দেন হাইকোর্ট। ব্যাখ্যা জানাতে তাঁকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ধার্য তারিখে তিনি হাজির হননি। ৮ নভেম্বর হাইকোর্ট হাবিবুরকে খুঁজে বের করে অবিলম্বে আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দেন। এক বার্তায় গত মঙ্গলবার হাবিবুরকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় র‌্যাব। আজ বেলা দুইটার দিকে তাঁকে আদালতে হাজির করে শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ।

আদালতে হাবিবের পক্ষে আইনজীবী মো. ফজলুর রহমান, মাহবুব উদ্দিন খোকন, মো. রুহুল কুদ্দুস ও সৈয়দ মামুন মাহবুব উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম মাসুদ রুমি। এ ছাড়া বিএনপিপন্থী আইনজীবীদেরও দেখা যায়।

ক্রম অনুসারে বিষয়টি উঠলে প্রথমে ল্যাপটপের মাধ্যমে হাবিবের দেওয়া বক্তব্য শোনানো হয়। তাঁর উদ্দেশে আদালত বলেন, শপথ করে বলেন ওই বক্তব্য আপনার কি না? তখন হাবিব বলেন, ‘শপথ করে বলছি বক্তব্যটি আমার। তবে আমার কিছু কথা আছে, যদি অনুমতি দেন। পরে হাবিব বলেন, কী কারণে বলেছি, খালেদা জিয়ার জীবন বিপন্ন।…আমার সাজা যদি এক শ বছরও হয়, তাহলেও কিছু বলার নেই। গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে চার বছর সাজার রায় হয়েছে। গাড়ির নম্বর প্লেট নেই, চেসিস নম্বর নেই—১৫ জনকে সাজা দিয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা এক শ, দেড় শ–দুই শ। তিন বছর আগে মারা গেছেন, তাঁর নামেও মামলা হয়েছে। এ অবস্থা চলছে।’

শুনানির একপর্যায়ে হাবিবের উদ্দেশে আদালত বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলার সময় সতর্ক থাকতে হবে। রায় বা আদেশে সংক্ষুব্ধ হলে সে জন্য ফোরাম আছে। ফোরামের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। যদি বিচারপতিদেরকে কবর দিতে চান, মারা যাওয়ার পর বিচারপতিকে তুলে নিয়ে আসতে চান, তাহলে বিচারপতি, বিচারক বা কোর্টকে কবর দিতে চান—তাহলে দেশকে কবর দেওয়ার সমান।

এরপর আদালত রায় দেওয়া শুরু করেন। শুরুর একপর্যায়ে আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বলার সুযোগ আছে কি? তখন আদালত বলেন, উনি (হাবিব) শপথ নিয়ে বলেছেন ওই বক্তব্য তাঁর। উনি বলেছেন, সবই শুনেছি। এরপর রায় দিতে থাকেন আদালত। সাজা ঘোষণার পর্যায়ে আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, তাহলে আমাদের (আইনজীবী) কথা বলতে হবে।

এর পরপরই হাবিবের পক্ষে কয়েকজন আইনজীবী ডায়াসের (যেখানে আইনজীবী দাঁড়িয়ে শুনানি করেন) সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তখন তাঁদের উদ্দেশে আদালত বলেন, আপনাদের কথা শুনব। প্লিজ, টেক ইয়োর সিট। আপনারা কি আমাদের থ্রেট করেন? তখন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, না, মাই লর্ড। আদালত বলেন, তাহলে আপনারা যেভাবে আসলেন। আপনারা কি অর্ডার পাস করতে বিরত রাখতে চান?

এরপর আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব আবারও বলেন, আমাদের কথা শুনবেন তো। আদালত বলেন, শুনেছি। তখন মামুন মাহবুব বলেন, শোনেননি। এর একপর্যায়ে সৈয়দ মামুন মাহবুবের প্রতি অবমাননার রুল ইস্যু করেন আদালত।

পরে আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সহায়তা করতে আসছি। তখন আদালত বলেন, উনি (হাবিব) এসেছেন, অভিযোগ শুনেছেন। শপথ করে উনি বলেছেন বক্তব্য দিয়েছেন। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন। ঘটনা স্বীকার করেছেন। এরপরে আদেশ দেওয়া হয়েছে।

‘কিছু শাস্তি সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে’
আদালত বলেন, কিছু কিছু শাস্তি সমাজের জন্য কল্যাণও বয়ে নিয়ে আসে। যখন একটি অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন, তখন কী প্রেক্ষাপটে বললেন মানুষ সেটি কিন্তু দেখে না, কাজটি দেখে। সেটিই মানুষের মাথায় চলে যায়। তাঁর (হাবিব) বক্তব্যের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে যে বার্তাটা দিয়েছেন, সবাই যদি এভাবে আক্রমণ করতে থাকে, তাহলে এই আদালত থাকবে না।

পরে আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি স্বীকার করে নিলে আইনজীবী হিসেবে বিরোধিতা করার সুযোগ থাকে না। হাবিব যথাযথভাবে রুলের জবাব দেওয়ার সুযোগ পাননি। হলফনামা দেওয়া হয়নি। আদালত বলেন, আদেশ দেওয়া হয়েছে। এতে ভুল হতে পারে। এ জন্য উপযুক্ত আদালত আছে। আপিল বিভাগ আছে। উনি (হাবিব) শপথ করে বলেছেন ওই বক্তব্য তাঁর। এরপর এজলাস ত্যাগ করেন বিচারপতিরা।