ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় বৃষ্টির ওপর চাপালেন মন্ত্রী

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম আজ রোববার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধবিষয়ক জাতীয় কমিটির সভায় বক্তব্য দেন
ছবি: পিআইডি

এ বছর ডেঙ্গুতে এরই মধ্যে এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর এই সংখ্যা এর আগে বাংলাদেশে যে বছর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার তিন গুণের বেশি। এখনো প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমালোচনার মধ্যেই স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম এর দায় চাপালেন বৃষ্টির ওপর।

আজ রোববার সচিবালয়ে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধবিষয়ক জাতীয় কমিটির সভায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, এবার বৃষ্টি হচ্ছে থেমে থেমে। ভারী বর্ষণ হলে এডিস মশার লার্ভা পানির সঙ্গে মিশে যেত। অল্প বৃষ্টি হওয়ার কারণে এডিস মশার উৎপাদন বেশি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে।

দেশে বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয় ২০০০ সালে। তখন ডেঙ্গুর চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা অনেকের কাছে নতুন ছিল। ওই বছর ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর প্রতিবছর ডেঙ্গুতে মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কোনো কোনো বছর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু হয়নি—এমন বছরও গেছে। এরপর ২০১৯ সালে বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ওই বছর ডেঙ্গুতে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন, মারা গিয়েছিলেন ১৭৯ জন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮৬৮ জন। আর এ বছর প্রথম ৯ মাসে মারা গেছেন ১ হাজার ৬ জন।

এ বছর ডেঙ্গুতে এত প্রাণহানি হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেভাবে মাঠে নামছে না বলে জনস্বাস্থ্যবিদ, কীটতত্ত্ববিদ ও ডেঙ্গু রোগবিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, দেশের পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ যেন প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করেনি। তাদের উদাসীনতায় ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে সবাইকে নিয়ে নামলে সুফল পাওয়া যেত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন। তিনি সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করুক, কিন্তু স্বীকার করে নিক যে পরিস্থিতি জরুরি অবস্থার মতোই। এটা স্বীকার করে সবাইকে নিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজে নামলে, চিকিৎসার কাজে নামলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকার গতানুগতিকভাবে চলছে। তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যেন প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দিয়েছে।’

ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে দুই বছর আগে এই জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। আজ ছিল কমিটির ষষ্ঠ সভা। কমিটির সভাপতি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। বৈঠকের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে তিনি ডেঙ্গু ও বৃষ্টির সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন। স্থানীয় সরকারসচিব মুহম্মদ ইবরাহিমের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিজানুর রহমানসহ অন্যরা বক্তব্য দেন। সভায় দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।

সভায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারি সংস্থাগুলো সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ৭ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের কথা রয়েছে। কিন্তু এর পাশেই একটি খাল আছে। যার পুরোটাই কচুরিপানায় ভরা। সেখানে মশার ওষুধ ছিটানো যাচ্ছে না।

মেয়র এ সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিকে অনুরোধ করেন যত দ্রুত সম্ভব খাল থেকে কচুরিপানা তুলে ফেলতে। তারপর ওই এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হবে।

আরও পড়ুন

আলোচনায় অংশ নিয়ে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব বলেন, ঢাকার বাইরে সিটি করপোরেশন ও জেলা পর্যায়ে ব্যাপক উন্নয়নকাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। বড় বড় স্থাপনা হচ্ছে। সেসব স্থাপনায় পানি জমে থাকে। সেখান থেকে এডিস মশার উৎপাদন হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকায় বহুতল ভবনে পানি জমে থাকলে সিটি করপোরেশন থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু জেলা পর্যায়ে তা দেখা যায় না। ঢাকার পাশাপাশি জেলা পর্যায়েও অভিযান পরিচালনা করার পরামর্শ দেন তিনি।

সভায় বক্তব্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিজেদের কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরে সমালোচনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করেন, আমরা সরকারি কর্মকর্তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে আছি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো কাজ করছি না। গণমাধ্যমে আমাদের সমালোচনা হচ্ছে। অথচ আমরা সব ছুটি বাতিল করেছি। মানুষকে সচেতন করতে মুঠোফোনে এসএমএস করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে বাচ্চাদের সচেতন করা হচ্ছে। তবু বলা হচ্ছে আমরা কিছু করছি না।’

পুলিশের থানাগুলোর সামনে পড়ে থাকা গাড়ি থেকে এডিস মশার জন্ম হচ্ছে উল্লেখ করে সেগুলোর সরানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন সেলিম রেজা। তিনি আরও বলেন, ঢাকায় অনেক সরকারি সংস্থা বিশাল বিশাল জমি নিয়ে বসে আছে। সেখানে গিয়ে মশার ওষুধ ছিটানো যাচ্ছে না। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় আনার তাগিদ দেন তিনি।

সভা শেষে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, অন্যান্যবারের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর হার বেশি। তবে মনে রাখতে হবে, এবার সক্ষমতাও বেশি। তিনি বলেন, ঢাকা শহর অনেক বড়। এখানে জনসংখ্যাও বেশি। সমালোচনা হতে পারে। তবে যদি যার যার বাড়ি পরিষ্কার রাখতে পারে, তাহলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার কমে আসবে।

এ সময় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, অনেক কাউন্সিলর তাদের এলাকায় নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটান না। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, কাউন্সিলররা কাজ করছেন। কেউ কেউ হতে পারেন, কাজ করছেন না। তবে সংখ্যাটা কম। এ সময় তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারি দপ্তরে অনীহা বেশি। তবে ধীরে ধীরে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে।

আরও পড়ুন