ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুই মামলা, নিষ্পত্তি হয়নি ১০ বছরেও

তারেক মাসুদের পরিবারের মামলাটি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। মিশুক মুনীরের পরিবারের মামলাটি হাইকোর্টে।

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর

১১ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীরের মৃত্যুতে দুই পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা পৃথক দুটি মামলা দুই ধাপে রয়েছে। তারেক মাসুদের পরিবারের করা মামলা হাইকোর্টের গণ্ডি পেরিয়ে এখন আপিল বিভাগে শুনানি শুরুর অপেক্ষায়। অন্যদিকে মিশুক মুনীরের পরিবারের পক্ষ থেকে করা ক্ষতিপূরণ মামলাটি হাইকোর্টে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন। তাঁরা কাগজের ফুল ছবির শুটিং স্পট দেখে ঢাকায় ফিরছিলেন।

ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ঘিওর থানায় মামলা করে। ঘটনার প্রায় ছয় বছর পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক রায়ে মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত দায়রা জজ বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি জরিমানা করেন। কারাবন্দী এই বাসচালক চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২০ সালের ১ আগস্ট মারা যান।

এদিকে দুর্ঘটনার পর ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের পরিবার মানিকগঞ্জ জেলা জজ আদালতে মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী বাসমালিক, চালক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে পৃথক মামলা করে। বাদীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে মামলা দুটি হাইকোর্টে বদলি হয়। এর মধ্যে তারেক মাসুদের পরিবারের করা মামলায় ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দিয়েছেন। এই রায়ের পর বাসমালিকপক্ষ ও বাদীপক্ষ পৃথক আপিল করে, যা আপিল বিভাগে শুনানি শুরুর অপেক্ষায়।

বাসচালক জামিরের আইনজীবী আবদুস সোবহান তরফদার গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিপূরণ মামলায় মিশুক মুনীরের পরিবারের আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বাসচালক জামিরের মৃত্যুসংক্রান্ত প্রতিবেদন কারা কর্তৃপক্ষকে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। জামিরের মৃত্যুসংক্রান্ত প্রতিবেদন এলে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বলা যাবে।

ক্ষতিপূরণের দুই মামলা দুই ধাপে

তারেক মাসুদের পরিবারের করা ক্ষতিপূরণ মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। রায়ে বলা হয়, ওই অর্থের মধ্যে বাসের দুই অপারেটর ও এক মালিক যৌথভাবে ৪ কোটি ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫২ টাকা দেবেন। রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড দেবে ৮০ হাজার টাকা। আর বাসচালক (চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স) দেবেন ৩০ লাখ টাকা। মোট অর্থের মধ্যে ১০ লাখ টাকা তারেকের মা নুরুন নাহার এবং বাকি অর্থ তারেকের স্ত্রী ও ছেলেকে দিতে বলা হয়েছে। বিবাদীপক্ষকে ছয় মাসের মধ্যে ওই অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়।

দুই পরিবারের অন্যতম আইনজীবী রমজান আলী শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, তারেক মাসুদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ মামলায় হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে বাসমালিকপক্ষ ও বাদীপক্ষের করা পৃথক আপিল শুনানির অপেক্ষায়। আপিল শুনানির দিন ধার্যের জন্য চলতি সপ্তাহে চেম্বার আদালতে আবেদন করা হবে। মিশুক মুনীরের পরিবারের করা ক্ষতিপূরণ মামলায় হাইকোর্টে বাদীপক্ষের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। তবে বিবাদীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর পর্যায়ে বাসচালক মারা যান। ৩ আগস্ট হাইকোর্ট বাসচালকের মৃত্যুসংক্রান্ত তথ্যাদি আদালতে দাখিল করতে কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। এই তথ্যাদি ২২ আগস্টের মধ্যে দাখিল করতে বলা হয়েছে।

বাসচালকের মৃত্যু ও ক্ষতিপূরণ আদায় বিষয়ে আইনজীবীরা বলছেন, ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলায় ক্ষতিপূরণ দিতে যার ওপর ডিক্রি (আদেশ) হয়, তাকে ওই অর্থ পরিশোধ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মারা গেলেও তাঁর আইনগত উত্তরাধিকার থেকে ওই অর্থ আদায়ের সুযোগ আছে। বাসচালক মারা গেলেও ক্ষতিপূরণ মামলা স্বাভাবিক নিয়মে চলবে।

সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলি কাজী। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার মহামারি না এলে ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামালায় এত দিনে নিশ্চয়ই রায় পেয়ে যেতাম। গত মাস থেকে হাইকোর্টে মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগলেও শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার পাবেন, এমন আশা তাঁর।’

এদিকে সড়কে অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায়ÿক্ষতিগ্রস্ত সব ব্যক্তির ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন দাবি জানায় ব্লাস্ট।

ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেছেন, ‘আমরা এখনো দেখি যেসব পরিবার ও ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন বা শারীরিক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাঁদের জন্য একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা এবং যথার্থ ও দ্রুত ক্ষতিপূরণ প্রদানে কার্যকরী ব্যবস্থা দাঁড়াচ্ছে না।’

বিজ্ঞপ্তিতে তারেক মাসুদের স্ত্রী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্যাথরিন মাসুদের বক্তব্য উল্লেখ রয়েছে। এতে তিনি বলেন, ‘আমাদের আপিলের পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য সড়ক দুর্ঘটনায় বিমা কোম্পানির দায়বদ্ধতা সুস্পষ্ট করা। আমাদের আশা ছিল যে এই মামলা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা বাড়বে সব মানুষের জন্য। এই পর্যন্ত¯আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।’