পঞ্চগড়ে উত্তেজনা থামছে না

গতকাল রাতের গুজব ঘিরে দোকান লুট। মাইক্রোবাস পুড়িয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। রাতে মুঠোফোনে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত।

আগুনে পুড়ে গেছে ঘরবাড়িসহ সব মালপত্র। গতকাল দুপুরে পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চগড়ে আহমদিয়া জামাতের ‘সালানা জলসা’কে কেন্দ্র করে বৃহস্পতি ও শুক্রবারের হামলার ঘটনায় প্রশাসন ও পুলিশ যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারেনি—গতকাল শনিবার সারা দিন ধরেই এমন আলোচনা চলছিল। এই পরিস্থিতির মধ্যেই গতকাল রাতে একটি গুজবকে ঘিরে পঞ্চগড় শহরে বিক্ষোভকারীদের আবারও জড়ো হতে দেখা যায়।

‘আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা দুজনকে গলা কেটে হত্যা করেছে’—গতকাল রাত পৌনে নয়টার দিকে এমন গুজব ছড়ানো হয়। এরপর অনেকেই রাস্তায় নেমে আসেন লাঠিসোঁটা নিয়ে। গুজবকে ঘিরে শহরের একটি জুতার দোকান লুটপাটের ঘটনাও ঘটে রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে। রাত ১০টার দিকে শহরের প্রেসক্লাব থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার শব্দ শোনা যায়। এ ছাড়া রাত ১০টার দিকে ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় একটি মাইক্রোবাস পুড়িয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। রাত ১২টার পর মুঠোফোনের ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যাচ্ছিল না।

গুজব থামাতে জেলা প্রশাসন রাত সাড়ে ৯টার দিকে প্রথমে বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাইকিং করে। পরিস্থিতি এরপরও নিয়ন্ত্রণে না এলে শহরের বিভিন্ন সড়কে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়। তবে রাত ১২টার দিকে জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি শান্ত হচ্ছে। শহরে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি টহল দিচ্ছে।

সালানা জলসাকে ঘিরে পঞ্চগড় শহরে শুক্রবার বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে প্রায় ছয় ঘণ্টা সংঘর্ষ হয়। এতে আরিফুর রহমান (২৮) ও জাহিদ হাসান (২৩) নামের দুই তরুণ নিহত হন। এ ছাড়া পুলিশ-সাংবাদিকসহ শতাধিক আহত হন।

এ জলসা বন্ধের দাবিতে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেয় বেশ কয়েকটি ইসলামি দল ও সংগঠন। ওই দিনই আহমদিয়া জামাতের দুটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এর আগে ২০১৯ সালেও জলসাকে ঘিরে হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

শুক্রবারের হামলার জন্য আহমদিয়া সম্প্রদায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেছে। তবে পুলিশের দাবি, তারা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে।

হামলার পর গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘটনাস্থল আহম্মদনগর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া কিছু বাড়ি থেকে তখনো ধোঁয়া উড়ছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আহম্মদনগর উচ্চবিদ্যালয়ের অফিস কক্ষ, বিজ্ঞানাগারসহ সাতটি শ্রেণিকক্ষ। বাড়িঘর ও আসবাবের অবশিষ্টাংশে হাতড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

সেখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেন জলসা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক আহমদ তবশির চৌধুরী। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ও প্রদত্ত গাইডলাইন সাপেক্ষে এবার ৩ থেকে ৫ মার্চ ৯৮তম জলসার আয়োজন করা হয়েছিল। জলসা শুরুর আগের রাতে (বৃহস্পতিবার) জলসা বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হয় এবং কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন দুষ্কৃতকারীরা। রাতেই জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জলসা আয়োজকদের নিশ্চয়তা দেন, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন তৎপর। কিন্তু শুক্রবার জলসা শুরু হলে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। চালানো হয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা।

আহমদিয়াদের হিসাব অনুযায়ী, তাঁদের ১৫০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। নষ্ট হয়েছে গাছপালা, খেতখামার। মারা পড়েছে গৃহপালিত প্রাণীও।

হামলার পেছনে কারা

জলসা বন্ধের দাবিতে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পঞ্চগড় শাখা, ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি, ইমাম-মোয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতি, পঞ্চগড় কওমি ওলামা পরিষদ ও জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ। আর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। ওই দিন আহমদিয়াদের বাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটে।

আর শুক্রবার পঞ্চগড় শহরের বাজার জামে মসজিদ থেকে সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা জুমার নামাজের আগে কথা বলেন। তাঁরা বলেন, ‘নামাজের পরে থাকুন। মিছিল হবে।’ পরে তাঁদের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি এম আর কলেজ মোড়ে যায়। সেখানে আরও কয়েকটি মিছিল আসে। এরপর তাঁরা চৌরঙ্গী মোড়ের দিকে যান। সেখানে মূলত পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

ওই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ পঞ্চগড় জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ বলেন, তিনি বাজার জামে মসজিদে নামাজ পড়েননি। তবে এম আর কলেজ মোড়ে মিছিল এলে তিনি সেখানে দোয়া পড়ান। এরপর বাড়ি চলে যান।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি জানান, শুক্রবার মিছিল নিয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের পরনে ছিল পাঞ্জাবি-টুপি। কিন্তু যাঁরা হামলা চালিয়েছেন, তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ পোশাকে।

আবার জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, শহর থেকে নদী পার হয়ে ও বোদা এলাকা হয়ে বিক্ষোভকারীরা জলসাস্থলে এসে হামলা করেন। তাঁদের অনেকের মুখে কাপড় বাঁধা ছিল। হামলাকারীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ।

পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

এর আগে ২০১৯ সালে হামলার ঘটনায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো মামলা নেয়নি পুলিশ। এ ছাড়া সেই সময় বিক্ষোভকারীরাও অভিযোগ দিয়েছিলেন। সেই ঘটনায়ও মামলা নেওয়া হয়নি।

শুক্রবারের হামলার ২৪ ঘণ্টা পেরোনোর পরও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এ ছাড়া এ ঘটনায় কাউকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ঘটনার জেরে কোনো তদন্ত কমিটি বা মামলাও করা হয়নি। সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে বৃহস্পতিবার থেকেই উত্তপ্ত ছিল পঞ্চগড় শহর। পুলিশের ভাষ্য, বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর তারা সতর্ক অবস্থানে ছিল এবং আহম্মদনগরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। শুক্রবারের ঘটনায় শহরের একাধিক মসজিদ থেকে মিছিল বের হলেও পুলিশ তা আটকাতে পারেনি।

এ বিষয়ে পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায় যে অসহযোগিতার অভিযোগ করেছে, তা সঠিক নয়। যদি তা-ই হতো, পুলিশের অফিস পুড়ত না, পুলিশের ৫০ সদস্য আহত হতেন না।

২০১৯ সালের হামলার ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের আরও তৎপর হওয়া উচিত ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। জলসাস্থলসহ শহরকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টিও পুলিশকে ভাবতে হয়েছে।

জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর ইসলামী আন্দোলন, ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি, সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদসহ ইসলামি সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল। সেখানে তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, শুক্রবার কোনো মিছিল হবে না। সেই কথা তাঁরা রাখেননি।