শেখ হাসিনা–আসাদুজ্জামান–মামুন কে কোন অপরাধে সাজা পেলেন

শেখ হাসিনা (বাঁয়ে), আসাদুজ্জামান খান কামাল (মাঝে), চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন (ডানে)ছবি: কোলাজ

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, সেটা রায়ে উল্লেখ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তিনিসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল পাঁচটি। অভিযোগের কোনটিতে কী সাজা, সেটিও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় এই প্রথম কোনো মামলার রায় হলো। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গতকাল সোমবার এ রায় দেন।

আরও পড়ুন
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল
ছবি: কোলাজ

গত বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ ফজলে নূর তাপসের এবং পরে হাসানুল হক ইনুর কথোপকথন অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যার নির্দেশ দেন। অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তাঁর অধীনস্থদের কোনো বাধা দেননি। ফলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে ছয়জন আন্দোলনকারীকে পুলিশ গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। একই দিন আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেয় পুলিশ।

এই তিন ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে। এই মামলা–সংশ্লিষ্ট যাঁরা ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি আহত আন্দোলনকারীদের আঘাতের মাত্রা ও ক্ষতি বিবেচনায় পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

এ মামলায় মোটাদাগে পাঁচটি অভিযোগ হচ্ছে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় অপর অভিযোগের তিনটিতে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগের ভাষ্য, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ সম্বোধন করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। একই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথন হয়। আন্দোলনকারীদের রাজাকার উল্লেখ করে তাদের ফাঁসি দেবেন বলে শেখ হাসিনা উসকানি ও আদেশ দেন। অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তাঁর অধীনস্থদের কোনো বাধা দেননি। ফলে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এই তিন অপরাধে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

সাবেক আইজিপির পাঁচ বছর কারাদণ্ড

সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন
ফাইল ছবি

সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, এই মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন, পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর জানার বিষয় ও সত্য প্রকাশের মাধ্যমে। তিনি স্বীকার করেছেন ৩৬ দিনের আন্দোলনের সব ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর অবদান, স্বীকার করার সঙ্গে বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় তাঁর সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে, যেখানে অপরাধের সম্পৃক্ততায় সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু ঘটনা উন্মোচনে তাঁর অবদানের দিক বিবেচনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

রায়ের পর প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম প্রথম আলোকে বলেন, তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। পাঁচটি অভিযোগকে ছয়টি কাউন্টে (ঘটনা বা বিষয়) ভাগ করে দুটি অভিযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ শীর্ষ নেতৃত্বের দায় (সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি)। অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া যায়। অপরাধের নৃশংসতা, গুরুত্ব ও গভীরতা বিবেচনায় তিনটি কাউন্টে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর তিনটি কাউন্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

দুটি অভিযোগেই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হয়েছেন। তিনি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য, তবে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন এবং তাঁর দেওয়া সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালের সঠিক রায় বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করেছে—এসব দিক বিবেচনায় এই সাজা দেওয়া হয়েছে।