অধ্যাপক মাতস্যুয়োর পরিবার

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

আমার শিক্ষা ও কর্মজীবনে বহু দেশ ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। অনেক স্পর্শকাতর, মানবিক ও বিচিত্র পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, যা আজও স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে।

গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে প্রবন্ধ বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশ করা ছাড়া আমার লেখালেখির অভ্যাস একেবারেই নেই। প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় পাঠকের লেখা পড়ে আমি অনুপ্রাণিত হলাম আমার স্মৃতিতে জমে থাকা একটি ঘটনা আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে।

ঘটনাটি ছিল ২০১০ সালে, জাপানে। আমি তখন জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক। জাপানি অধ্যাপক ড. মাতস্যুয়ো ছিলেন আমার সহকর্মী ও হোস্ট অধ্যাপক। জাপানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে, ওই বিভাগের একজন জে৵ষ্ঠ অধ্যাপকের সুপারিশপত্র অত্যাবশ্যক, যিনি হোস্ট অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত থাকেন। অধ্যাপক মাতস্যুয়ো ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও আন্তরিক। একাডেমিক কাজের পাশাপাশি জাপান ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি, পারিবারিক ঐতিহ্য ও কাঠামো ইত্যাদি বিষয়ে সব সময় আমাদের মধে৵ আলোচনা হতো। আমরা দুজনই দুই দেশের এ বিষয়গুলোতে অনেক মিল খুঁজে পেতাম।

জাপানের এক সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববার মাতস্যুয়ো তাঁর বাড়িতে আমাকে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ জানালেন। আমি থাকতাম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের হুগো ক্যাম্পাসের ডরমিটরিতে। আর মাতস্যুয়োর বাড়ি ছিল শহরের একটু বাইরে। মাতস্যুয়ো আমাকে ডরমিটরি থেকে তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমি তা বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিলাম; বরং তাঁর কাছ থেকে ঠিকানা, নিকটবর্তী রেলস্টেশন ও ট্রেনের সময় জেনে নিলাম। নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে রেলস্টেশনে নেমে দেখি, মাতস্যুয়ো গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা অধ্যাপক মাতস্যুয়োর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। তাঁর স্ত্রী ফুলের তোড়া নিয়ে মাথা নুয়ে আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। তাঁর বাড়ি রাজকীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ। তবে বাড়িটি উঁচু অট্টালিকা নয়, চারদিকে ফুল ও সবজির বাগানঘেরা একতলা পরিপাটি ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। ঘরে ঢুকেই আমি বিমুগ্ধ হলাম। ড্রয়িংরুমে বসে কিছু কোমল পানীয় পান করলাম, খানিক গল্প হলো। এরপর ডাইনিং রুমে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো মধ্যাহ্নভোজের জন্য। জাপানের ঐতিহ্যবাহী ডাইনিং টেবিল ছয় আসনবিশিষ্ট ‘তাতামি’র নির্ধারিত স্থানে আমাকে বসানো হলো। তাঁর স্ত্রী ও ছোট মেয়ে এরিকো (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী) তাঁদের নির্ধারিত আসনে বসলেন।

আমি মাতস্যুয়োকে বসার অনুরোধ করলে তাঁদের পরিবারের আরও একজন সদস্য অর্থাৎ তাঁর বড় মেয়ে আসবে বলে শয়নকক্ষের দিকে তিনি চলে গেলেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাকে বাক্‌রুদ্ধ করে দিয়ে মাতস্যুয়ো তাঁর বড় মেয়েকে পাঁজাকোলা করে এনে তাতামির একটি চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। পাশের চেয়ারে নিজে বসলেন। আমার সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর বড় মেয়ের নাম এনরিকো। মেয়েটির গলায় ন্যাপকিন বাঁধা, ঠোঁট বাঁকানো—মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। আমি হ্যালো বললাম, স্বাভাবিকভাবেই কোনো প্রত্যুত্তর পেলাম না। মিসেস মাতস্যুয়ো অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জানান, টেবিলে পরিবেশিত সব খাবার হালাল। তিনি একে একে সব খাবারের বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। টেম্পুরা ও মিসো স্যুপ নামের দুটি খাবার দিয়ে শুরু করে ডেজার্ট ও ফলফলারি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ শেষ করলাম। অধ্যাপক মাতস্যুয়ো নিজে খাচ্ছিলেন, ফাঁকে ফাঁকে অত্যন্ত যত্নসহকারে বড় মেয়ে এনরিকোকে খাওয়াচ্ছিলেন। ন্যাপকিন দিয়ে বারবার তিনি মেয়ের মুখ পরিষ্কার করে দিচ্ছিলেন। মাতস্যুয়ো ও তাঁর পরিবারের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বহুগুণ বেড়ে গেল। বিমুগ্ধ চিত্তে এ অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করার সৌভাগ্য হলো আমার।

জাপানের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক গঠন ও ঐতিহ্যের আমি যে মিল পেয়েছিলাম, এখানে এসে হোঁচট খেলাম। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারে প্রতিবন্ধী সদস্য থাকা অভিশাপ ও লজ্জার বলে মনে করি। আমাদের প্রবণতা ও মানসিকতা হলো পরিবারের প্রতিবন্ধী সদস্যকে লুকিয়ে রাখা। তবে একটি প্রতিবন্ধী শিশুকে পরিবার যদি সম্মান দেয়, সমাজও তাকে সম্মান না দিয়ে পারে না।

  • সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন