বাংলাদেশকে অধিকতর শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য রাজনীতিক, জাতি-ধর্মের নেতৃবৃন্দসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে অহিংস উদ্যোগ নিতে হবে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ আহ্বান জানান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা।
ইউকে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের সহযোগিতায় দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের মাল্টি-স্টেকহোল্ডার ইনিশিয়েটিভ ফর পিস অ্যান্ড স্ট্যাবিলিটি (এমআইপিএস) প্রকল্প এ বৈঠকের আয়োজন করে। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।
সূচনা বক্তব্যে হাঙ্গার প্রজেক্টের এদেশীয় পরিচালক প্রশান্ত ত্রিপুরা বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’ সামনে রেখে এই গোলটেবিল আয়োজন করা হয়েছে। এমআইপিএস ২০২৩ সাল থেকে রাজনৈতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করছে। এ আলোচনায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সহিংসতা প্রতিরোধে যে পরামর্শ দেবেন এবং এমআইপিএসের কর্মীরা তাঁদের যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করবেন, সেখান থেকে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস উদ্যাপনের একটি কর্মপরিকল্পনা করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত সহিংসতা তো আছে। এ ছাড়া সমাজে অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভূমিবিরোধ, জেন্ডার, শ্রেণি, পদপদবি, শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতিগত বহু ধরনের সহিংসতা বিরাজমান। এখানে আমাদেরই শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অন্য কোনো দেশে থেকে শান্তি–সম্প্রীতি ধার করে আনা যাবে না।’
হাঙ্গার প্রজেক্টের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, হাঙ্গার প্রজেক্ট স্বেচ্ছাব্রতী সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। ২০১৩ সাল থেকেই দেশে শান্তি নিয়ে কাজের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। তখন সহিংসতামুক্ত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পরে ২০২৩ সাল থেকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনে সম্মিলিত উদ্যোগ বা এমআইপিএসের কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন জাতি-ধর্মের মানুষ, রাজনীতিক, ধর্মগুরুদের একত্র করে তাঁদের সচেতন করতে অহিংসভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। বোঝাতে হবে সমাজে সহিংসতা বজায় থাকলে শেষ বিচারে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর সবাই চাইলেই শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে।
গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, সহিংসতা কেন হচ্ছে, তার গোড়ায় গিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। প্রতিরোধ, সুরক্ষা, পুনর্বাসন ও সবার অংশগ্রহণের মতো বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক রফিকুল ইসলাম আন্তধর্মীয় সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, রামু, নাসিরনগরের মতো সহিংস ঘটনাগুলোতে দেখা গেছে ধর্মকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করে অপরাজনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সব ধর্মের মূলেই রয়েছে মানবকল্যাণ ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদ। ধর্মে জোরজবরদস্তির সুযোগ নেই। মানুষকে এ বিষয়গুলো ভালোভাবে বোঝাতে হবে।
ন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশের সভাপতি বিশপ ফিলিপ অধিকারী বলেন, ‘শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ হিসেবে আমাদের দেশের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে কিছু গোষ্ঠী ধর্মীয় সহিংসতা ও বৈষম্যে সৃষ্টি করে সেই ঐতিহ্য বিনাশের চেষ্টা করেছে। এই অপচেষ্টা প্রতিরোধ করতে সব ধর্মীয় নেতা, যুব ও তরুণদের নিয়ে অহিংসমূলক উদ্যোগ নিতে হবে। ভিন্নমত গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করতে হবে।’
মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান বলেন, দেশে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখা এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। গত এক বছরে জাতিগত সহিংসতা থেকে যত সহিংস ঘটনা ঘটেছে, তা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে আমাদের দেশের অংশগ্রহণ সব থেকে বেশি। অথচ আমাদের দেশেই শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। সহিংসতার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে।’
সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন অর বিলিফের পরিচালক শুভ্র দেব কর বলেন, অপরাজনীতি করে অনেক সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করা হয়েছে ভোটব্যাংক হিসেবে। তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। এখন ‘মব’ সন্ত্রাসের নামে আরেক ধরনের সহিংসতা হচ্ছে। আইন হাতে তুলে নেওয়া হচ্ছে। সরকারকে এসব দমনের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেমের এ দেশীয় উপপরিচালক রুমানা আমিন বলেন, দেশে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সমাজজীবনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায়ে রাখতে হবে।
যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক বক্তব্য দেন। তাঁদের একজন ম্যাথিল্ডা মেট্রট বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সহিংসতার শিকার হলেও তারা অনেক সময় আইনি সহায়তা পায় না। এ বিষয়ে কাজ করতে হবে।
অন্য গবেষক জো ডিভাইন বলেন, সহিংসতা দমনে পুরোনো ধ্যানধারণা কাজে আসেনি। নতুন চিন্তা ও উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের উপকর্মসূচি পরিচালক নাজমুন নাহার। আরও বক্তব্য দেন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা হাঙ্গার প্রজেক্টের ‘পিএফজি’ ও ‘ওয়াইপিএজি’ দলের সদস্যরা। তাঁরা হলেন নরেন পাহান (নওগাঁ), এস কে হাসিব (বাগেরহাট), মাহবুবুর রহমান চৌধুরী (সিলেট), ডলি দাস (নওগাঁ), নূপুর খন্দকার (কুমিল্লা), জারিন মুনতাহা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), সমাপ্তি গাইন (সাতক্ষীরা), শিমু চৌধুরী (হবিগঞ্জ) ও রাকিবুল হাসান (নওগাঁ)।
বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।