এই জনপদটির মানুষের উদ্বেগ-বিষণ্নতা কেন এত বেশি

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় একটি জনপদের ২৫ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র উদ্বেগের মধ্যে থাকে। একই এলাকার প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র বিষণ্নতায় ভুগছে। উদ্বেগ ও বিষণ্নতার এই হার জাতীয় হারের চেয়ে অনেক বেশি।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি হয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে। এ ইউনিয়নের মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ এবং নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নটি ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলাসহ প্রায় প্রতিটি দুর্যোগের শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখানে দৃশ্যমান। গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, দুর্যোগে মানসিক আঘাত পাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাঁর নিজেরও আছে। সেই অভিজ্ঞতার কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি গবেষক দলকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, গবেষণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ভিত্তি তৈরি করল। আইনুন নিশাত অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তিনি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

গবেষকেরা মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ৬৫৩ জন নারী-পুরুষের ওপর জরিপ করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ছয়টি দলগত সভার মতামত নিয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া তাঁরা সরকারি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা–কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ১৫ জনের বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এর ভিত্তিতে তাঁরা গবেষণা ফলাফল তৈরি করার পাশাপাশি করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করেছেন।

অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের সমন্বয়কারী শারমিন নাহার ও একই প্রতিষ্ঠানের জনস্বাস্থ্য–বিশেষজ্ঞ মো. সাইফুল ইসলাম। দুজনই এই গবেষণার সহমুখ্য ইনভেস্টিগেটর।

গবেষণায় দেখা গেছে, এলাকার মানুষ ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, বন্যা, নদীভাঙন, খরা, অল্প সময়ে বিপুল বৃষ্টি, বজ্রপাত, ঘন কুয়াশার মুখোমুখি হচ্ছেন। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে কৃষির ওপর। প্রভাব পড়ছে মৎস্যসম্পদ, প্রাণিসম্পদ ও স্বাস্থ্যের ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অবকাঠামো, প্রাণিসম্পদ, বন ও শিক্ষা। সুনির্দিষ্টভাবে মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পানীয় জলের সংকট তৈরি হয়েছে, খাদ্যঘাটতি আছে, মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সমস্যা আরও আছে। এলাকার মানুষ মনে করেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক সংঘাত, এলাকায় বাল্যবিবাহ, অভিবাসন, শিশুশ্রম বেড়েছে। এসব কারণে ক্ষতি হয়েছে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের।

মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি

এলাকার মানুষ গবেষকদের বলেছেন, মানুষের মধ্যে রুষ্ট আচরণ দেখা যাচ্ছে। তাঁরা ভয়ের মধ্যে থাকেন। তাঁদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে, ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। তাঁরা দুঃস্বপ্ন দেখছেন, অনেকে বাঁচার ইচ্ছা হারিয়েছেন, অনেকের কাজের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।

গবেষকেরা বিজ্ঞানভিত্তিক মানদণ্ডে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পরিমাপ করার চেষ্টা করেছেন। এতে দেখা গেছে, দেশের উপকূলের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বেশ খারাপ।

সর্বশেষ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে (২০১৯) দেখা গেছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। এর মধ্যে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ভোগে বিষণ্নতায়, ৪ দশমিক ৭ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগ বেশি।

গবেষণায় দেখা গেছে, মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র বিষণ্নতায় ভুগছে। পাশাপাশি মাঝারি থেকে তীব্র উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে ২৫ শতাংশ মানুষ। দুটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এলাকার মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ অনেক বেশি। এ ছাড়া এলাকার ৪৯ শতাংশ মানুষ মানসিক চাপে থাকে। ৪৪ শতাংশ মানুষের ঘুম ভালো হয় না।

অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘকাল ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মধ্যে থাকলে মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হতে পারে, মানুষের আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। একটি পর্যায়ে মানুষের বিশ্বাসেও পরিবর্তন আসতে পারে। পরিবর্তন ঘটতে পারে নৃতাত্ত্বিক। এ বিষয়ে গবেষণার নতুন প্রস্তাব করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার, সুইডেন দূতাবাসের স্বাস্থ্য খাত–বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল নোভাক এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জেসমিন নাহার। জনস্বাস্থ্যবিদ জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের কর্মসূচি উপদেষ্টা ইয়াসমিন এইচ আহমেদ। সমাপনী বক্তব্য দেন একই প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি পরিচালক শেখ মাসুদুল আলম।