‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলা মঙ্গলজনক

অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয় ও সেন্ট জোন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ১৯৯৮ সালে পরিবেশবিষয়ক প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক—বেন’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০০০ সালে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদ-নদী এবং বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ। সাক্ষাৎকারের দুই পর্বের প্রথম কিস্তি আজ।

নজরুল ইসলাম

প্রশ্ন :

তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গে দুটি খাল খননের পরিকল্পনার কথা জানা গেছে। খাল দুটি খনন করা হলে বাংলাদেশের ওপরে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

নজরুল ইসলাম: তিস্তার উজানে ভারত গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতীয় অংশে সেচের সম্প্রসারণ। এই বাঁধ দিয়ে প্রথম পর্যায়েই প্রায় ১০ লাখ হেক্টর, অর্থাৎ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সে জন্য ২১০ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল করা হয়েছে। এসব খাল একদিকে পশ্চিম-দক্ষিণে অগ্রসর পশ্চিমবঙ্গের মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যন্ত পৌঁছেছে; অন্যদিকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলা পর্যন্ত গেছে। অর্থাৎ, গজলডোবা বাঁধ একটি বিস্তৃত পরিধিতে সেচ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে। এখন যে নতুন দুটি খাল খনন করা হচ্ছে, তা এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের বাস্তবায়নের অংশ বলেই মনে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয়, ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পানি অপসারণের একটি উচ্চ সীমা আছে, সেটা হলো ৪০ হাজার কিউসেক। যে ফিডার ক্যানেল দিয়ে গঙ্গার পানি ভাগীরথী নদীতে নেওয়া হয়, এটা হচ্ছে তার সক্ষমতা। কিন্তু গজলডোবার বাঁধের জন্য এমন কোনো উচ্চ সীমা নেই। ভারত নতুন নতুন খাল খননের মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি অপসারণের ক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

ওই দুটি খাল ভারতের গজলডোবা বাঁধের দ্বিতীয় পর্যায়ের অবকাঠামো হলে বাংলাদেশের ওপরে তার প্রভাব কী হতে পারে।

নজরুল ইসলাম: ভারতের পানি উন্নয়ন পরিকল্পনায় গজলডোবা বাঁধের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বাঁধ ভারতের ‘নদী সংযোগ পরিকল্পনা’র একটি অন্যতম অংশ। ইতিমধ্যেই এই বাঁধ তিস্তা থেকে পানি পশ্চিম দিকে নাগর-টাঙ্গন, ডাউক এবং মহানন্দা নদীতে এবং পূর্ব দিকে জলঢাকা নদীতে প্রবাহিত করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। সে লক্ষ্যে মহানন্দা নদীর ওপর জলপাইগুড়ি জেলার ফুলবাড়ীতে এবং ডাউক নদীর ওপর উত্তর দিনাজপুরের চোপড়াতে দুটি পিকআপ ব্যারেজ নির্মিত হয়েছে। ভবিষ্যতে ব্রহ্মপুত্র এবং তার বিভিন্ন উপনদী যেমন মানস, সংকোশ থেকে পানি ভারতের পশ্চিমে এবং দক্ষিণে প্রবাহিত হওয়ার জন্য এই বাঁধ ব্যবহৃত হবে। এ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের অংশ হিসেবে মহানন্দা নদীর ওপর তিনটি খালের সংযোগস্থলে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনেরও পরিকল্পনা রয়েছে। সুতরাং সব মিলিয়ে গজলডোবা বাঁধ বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার জন্য একটি বড় হুমকি। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে কতটা সচেতন ও মনোযোগী, তা স্পষ্ট নয়।

প্রশ্ন :

তিস্তার উজানে ভারতের বেশ কয়েকটি বাঁধ আছে। সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিত?

নজরুল ইসলাম: তিস্তার উজানে ভারতের আরও বাঁধ রয়েছে। গবেষক গৌরী নুলকার-ওক দেখিয়েছেন যে তিস্তার উজানে এবং এর বিভিন্ন উপনদীর ওপর ভারতের আরও প্রায় ১৫টি বাঁধ কিংবা ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের জন্য তিস্তার শুষ্ক মৌসুমের কোনো প্রবাহ যে অবশিষ্ট থাকবে না, তা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সুতরাং বাংলাদেশের পরিষ্কার অবস্থান হওয়া উচিত এসব পরিকল্পনার বিরোধিতা করা। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। অংশীদার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সম্মতি ভিন্ন এই আন্তর্জাতিক নদীর ওপর এ ধরনের হস্তক্ষেপ ভারত করতে পারে না। ইতিমধ্যেই গজলডোবা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তা নদীর প্রবাহ ‘ন্যূনতম পরিবেশসম্মত প্রবাহে’র নিচে চলে যায় এবং এই নদী শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।

প্রশ্ন :

আন্তর্জাতিক আইনে বাংলাদেশ তিস্তার পানির হিস্যা বিষয়ে কিছু করতে পারে? আন্তর্জাতিক নদী আইন আছে। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশ তো সেখানে স্বাক্ষর করেনি। তাহলে কী উপায়?

নজরুল ইসলাম: বাংলাদেশের একটি আশুকরণীয় হলো জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নদ–নদীসংক্রান্ত ১৯৯৭ সালের সনদে (কনভেনশনে) স্বাক্ষর করা।

ভারতসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশকেও তাতে স্বাক্ষর করতে উৎসাহিত করা। এই সনদে আন্তর্জাতিক নদ–নদীর প্রতি অংশীদারি দেশগুলোর আচরণ সম্পর্কে বিস্তারিত নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সব দেশকে এতে স্বাক্ষর করতে হবে। এতে উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে নদ–নদী সম্পর্কে বিরাজমান বিভিন্ন মতপার্থক্য নিরসনের সর্বসম্মত ভিত্তি সৃষ্টি হবে। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বহু স্বার্থ এই সনদে স্বীকৃত হয়েছে। এই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এই সনদে স্বীকৃত অধিকারগুলো আরও জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে পারে। বাংলাদেশ দেখাতে পারে যে তার অবস্থানের পেছনে বিশ্বসভার সমর্থন রয়েছে। এই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ নদ–নদীবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তার দাবিগুলো তুলে ধরতে পারে। দেখাতে পারে যে তার দাবিগুলো আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা স্বীকৃত। সুতরাং বাংলাদেশ আজও কেন ১৯৯৭ সালের ওই সনদে স্বাক্ষর করেনি, তা মোটেও বোধগম্য নয়। ভারত স্বাক্ষর না করলে কি বাংলাদেশ স্বাক্ষর করতে পারে না? এ ধরনের কি কোনো বাধ্যবাধকতা রয়েছে?

প্রশ্ন :

বাংলাদেশ ভাটিতে তিস্তায় চীনের সহায়তায় একটি প্রকল্প নিতে যাচ্ছে। সেটি হলে বাংলাদেশের জন্য কী ফলাফল বয়ে আনবে।

নজরুল ইসলাম: আপনি ঠিকই বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার চীনের পাওয়ারচায়না কোম্পানির মাধ্যমে পরিকল্পিত, অর্থায়িত এবং বাস্তবায়িতব্য ‘তিস্তা নদী সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্পের আলোচনায় আছে। অনেকে এটাকে সংক্ষেপে ‘তিস্তা মহা-পরিকল্পনা’ বলে অভিহিত করছেন। এ প্রকল্পের অনুমিত বাজেট প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। লক্ষণীয়, এ ধরনের একটি জনগুরুত্বসম্পন্ন এবং ব্যয়বহুল প্রকল্প সম্পর্কে সরকার জনগণকে কোনো কিছু জানানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে বলে মনে হয় না। এমনকি মুষ্টিমেয় লোকজন ছাড়া সরকারের অভ্যন্তরের বাকি লোকজনও এ বিষয়ে তেমন অবহিত নন বলে মনে হয়। জনগণের অর্থে নির্মিতব্য এবং কয়েক কোটি মানুষের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করার মতো এ ধরনের একটি প্রকল্প সম্পর্কে জনগণকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রবণতা দুঃখজনক। এদিকে বাংলাদেশ সরকার তার নাগরিকদের প্রকল্প বিষয়ে কিছু না জানালেও পাওয়ারচায়না কোম্পানি ইউটিউবে ভিডিওর মাধ্যমে এই প্রকল্পকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরছে।

যেহেতু সরকার এ প্রকল্প সম্পর্কে কোনো তথ্য গণ-পরিমণ্ডলে প্রকাশ করেনি, সেহেতু এই প্রকল্প নিয়ে অকাট্য মন্তব্য বা মূল্যায়ন পরিবেশন করা কঠিন। তবে আমাদের দেশের উৎসাহী সাংবাদিকেরা এই প্রকল্পের পিডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত প্রাথমিক প্রস্তাবনা) এবং আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যদিও এ প্রকল্প সম্পর্কে পাওয়ারচায়না যে বাস্তবায়ন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা  সম্পাদন করেছে বলে মনে হয়, তা এখনো তাদের হস্তগত হয়নি। যাহোক, উৎসাহী গবেষকেরা এ প্রকল্পের পিডিপিপি এবং পাওয়ারচায়নার ভিডিওতে লব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে কিছু বিশ্লেষণ উপস্থিত করছেন। তাদের এই বিশ্লেষণ থেকে বেরিয়ে আসে যে, এই প্রকল্প নিয়ে উৎসাহিত হওয়ার সুযোগ কম।

এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো, তিস্তা নদীর গড় প্রশস্ততা বর্তমান প্রায় ৩ কিলোমিটার থেকে ০.৮ কিলোমিটার (অর্থাৎ, এক-তৃতীয়াংশে) কমানো এবং বৃহৎ খননকাজের (ক্যাপিটাল ড্রেজিং) মাধ্যমে গড় গভীরতা ৫ মিটার থেকে ১০ মিটার করা। পাওয়ারচায়নার মতে, এটি হলে নদীগর্ভ থেকে ১৭১ বর্গকিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করা হবে এবং তা শিল্প, উন্নত কৃষি, শহর-নির্মাণ, পুনর্বাসন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তিস্তার গভীরতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে নদীতে বেশি পানি থাকবে এবং তা শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করা যাবে।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন, তিস্তা নদী দিয়ে এখন বছরে ৪ দশমিক ৯ কোটি টন পলি (মূলত বর্ষাকালে) প্রবাহিত হয়। ফলে খননের মাধ্যমে নদীর যে গভীরতা বৃদ্ধি পাবে, তা আবারও পলি দিয়ে ভরাট হয়ে যাবে। অন্যদিকে বর্ধিত গভীরতা কমে গিয়ে এক-তৃতীয়াংশে সরুকৃত নদী বর্ষার সব প্রবাহ ধারণ করতে পারবে না। নদী–তীরবর্তী বাঁধ ভেঙে আগের প্রশস্ততায় ফিরে আসতে পারে। ফলে গভীরতা বৃদ্ধি এবং প্রশস্ততার হ্রাস কোনোটাই স্থায়ী হবে না। আমার সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ: পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার শীর্ষক গ্রন্থে প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিস্তার উজানে ভারতের খাল খনন ও বাংলাদেশের ভেতরে চীনের প্রকল্প দুটি কাজই বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।

প্রশ্ন :

চীনের ওই প্রকল্প বাংলাদেশ না নিলে কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পানি পেতে পারে।

নজরুল ইসলাম: তিস্তা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশকে দ্বিমুখী তৎপরতায় নিয়োজিত হতে হবে। একটি হলো ভারতের সঙ্গে নদী বিষয়ে আলোচনার কৌশলের পরিবর্তন। এতকাল এই আলোচনায় বাংলাদেশ ভারতের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করেছে। কিন্তু তা দিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের তেমন কোনো লাভ হয়নি। সুতরাং সদিচ্ছার পরিবর্তে ভারতের স্বার্থের ভিত্তিতে নদ–নদীবিষয়ক আলোচনায় বাংলাদেশকে উদ্যোগী হতে হবে। আন্তর্জাতিক নদ–নদীর পুরো প্রবাহ ফিরে পাওয়ায় বাংলাদেশের যেমন স্বার্থ রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তার পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধার বিষয়ে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারেও এই সাতটি রাজ্যের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং ভারত-বাংলাদেশ আলোচনাকে ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলার ভিত্তিতে হতে হবে। এই ফর্মুলা অনুযায়ী ভারত সব আন্তর্জাতিক নদ–নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনর্বহাল করবে; বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, বন্দর ব্যবহারের সুযোগসহ নানা সুবিধা দেবে। বর্তমানে বাংলাদেশ নদ–নদীর প্রশ্নে কোনো ছাড় ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, বন্দর ব্যবহারের সুযোগ ইত্যাদি দিয়েছে। কিন্তু এ ধরনের একতরফা লেনদেনের স্থায়িত্বশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে। পক্ষান্তরে, ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলা একটি ন্যায্য ফর্মুলা এবং তা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক এবং স্থায়িত্বশীল হবে। ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলা বাংলাদেশকেই উত্থাপন করতে হবে। তিস্তার বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য দেশের অভ্যন্তরেও অনেক কিছু করার আছে। সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশ তো তিস্তা ব্যারাজ করেছে। এর দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে সরকার ভাবছে। এটি কতটুকু বাস্তবসম্মত।

নজরুল ইসলাম: বাংলাদেশের যেটা করা দরকার, তা হলো তিস্তা অববাহিকার পুনরুজ্জীবন। বাংলাদেশের নদ–নদী কোনো বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়। অন্যান্য নদ–নদী ও জলাধারগুলোর সঙ্গে এগুলো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। কিছু প্রকৌশলী অনেক সময় নদ–নদী ও জলাধারগুলোর এই পরস্পর সম্পর্কের প্রতি প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেন না। যেমন ব্রহ্মপুত্র ডান তীর বাঁধ প্রকল্পের প্রসারণ হিসেবে তিস্তা নদীর ডান তীর ধরে কাউনিয়া পর্যন্ত বাঁধ নির্মিত হয়। এর ফলে বহু শাখা নদী থেকে তিস্তা নদী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের জন্য মোট ৪ দশমিক ৪৯২ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছিল। ফলে পূর্ব থেকে রয়ে যাওয়া যে অসংখ্য খাল-বিল-নদী-নালা তিস্তা অববাহিকায় ছিল, সেগুলোকে অবহেলিত হয়। এগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। যেমন বাংলাদেশের ভেতর তিস্তার ডান তীরে ৭টি এবং বাম তীরে ৫টি শাখা এবং উপনদী আছে। এগুলোর সঙ্গে তিস্তা নদীর সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাহলে তিস্তার বর্ষাকালের প্রবাহ এসব নদী-নালা-খাল দিয়ে সারা অববাহিকায় বিস্তৃত হতে পারবে। শুষ্ক মৌসুমে এই সঞ্চিত পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হতে পারবে এবং ফিরতি প্রবাহের মাধ্যমে তা তিস্তা নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি করতে পারবে। সুতরাং বর্ষাকালের পানি ধরে রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।