২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

পয়োবর্জ্য থেকে তৈরি জৈব সার দেখাচ্ছে আশা

ট্রাকের মাধ্যমে পাইপ দিয়ে ঝামেলা ছাড়াই সংগ্রহ করা হচ্ছে পয়োবর্জ্য
ছবি: প্রথম আলো

নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভায় কয়েক বছর আগেও পয়োবর্জ্য ছিল এক দুশ্চিন্তার নাম। এগুলো পরিষ্কার করার জন্য নির্ভর করতে হতো পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ওপর। আবার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সেগুলো এখানে-সেখানে ফেললে তা ছিল পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। কিন্তু দিন দিন সেই আগের এখন অবস্থা বদলে যাচ্ছে। যন্ত্র দিয়ে পয়োবর্জ্য সংগ্রহ করে তা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নিরাপদ জৈব সার। পয়োবর্জ্য এখন আর দুশ্চিন্তার নাম নয়, উল্টো তা থেকে তৈরি জৈব সার আশা দেখাচ্ছে।

সৈয়দপুর পৌরসভা সূত্র জানায়, এখন সমন্বিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনায় সৈয়দপুর পৌরসভা ওয়াটারএইড বাংলাদেশের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে পয়োবর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের কাজ শুরু করে। ২০২১ সালে পয়োবর্জ্য শোধন শুরু হয়।

ওয়াটারএইডের প্রোগ্রাম অফিসার প্রকৌশলী মো. শাখাওয়াত হোসাইন জানান, সৈয়দপুর পৌরবাসীর পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি সমন্বিত উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা শহর গড়ে তোলার জন্য তাঁরা কাজ করছেন। সেই সঙ্গে সৈয়দপুর পৌরসভাকে তাঁরা কারিগরি সহায়তা দিচ্ছেন, যাতে পৌরসভা অন্তর্ভুক্তিমূলক স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে যায়। সরকার এ মডেল সব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে ব্যবহার করতে পারে।

পয়োবর্জ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার পর তা পয়োবর্জ্য শোধনাগারে ফেলা হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

গত মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডের প্রতিটি পাড়া-মহল্লার বাড়ি থেকে গৃহস্থালি ও মানববর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পয়োবর্জ্য খালি করতে পৌরসভায় লিখিত আবেদন করলেই বাসার সামনে চলে যায় বিশাল ট্যাংকসহ গাড়ি। ৩৩ হাজার পরিবার ও ৬টি হাটবাজারের মানববর্জ্য গাড়িতে সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেগুলো নেওয়া হয় শহরের সুরকী মহল্লার শোধনাগারে। ১৭০ শতক জমির ওপর গড়ে ওঠা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে ৫টি ধাপের মাধ্যমে কো-কম্পোজ জৈব সারে রূপান্তরিত করা হয়।

সৈয়দপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মশিউর রহমান জানান, আগে মেথরদের দিয়ে পয়োবর্জ্য পরিষ্কার করাতেন। কিন্তু পৌরসভা থেকে পয়োবর্জ্য সংগ্রহ করা ট্রাক চালুর পর তিনি বছরে একবার করে সেই ট্রাকের মাধ্যমে নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করিয়ে নিচ্ছেন। তিনি জানান, প্রথমে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মী এসে সেপটিক ট্যাংক দেখে যান। তা পরিষ্কার করার পর কতটুকু অপসারণ করা হলো, তা মেপে টাকার অঙ্ক বলে স্লিপ দিয়ে যান।

পরে তা পৌরসভার তহবিলে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা জমা দেন। তিনি বলেন, আগে বর্জ্য এখানে-সেখানে ফেলা হতো। পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ত। গন্ধ বের হতো। কোথায় বর্জ্য ফেলবে, সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু এখন আর সেই সমস্যা নেই। বর্জ্য সংগ্রহ করা ট্রাকে গন্ধ ও ঝামেলা ছাড়াই বর্জ্য অপসারণ করা যাচ্ছে। এতে তিনি খুশি। এ থেকে জৈব সার তৈরির উদ্যোগও প্রশংসনীয় বলে মনে করেন তিনি।

ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পাঁচটি ধাপের মাধ্যমে কো-কম্পোজ জৈব সারে রূপান্তরিত করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

এখন কৃষকদের মধ্যে বিক্রি হচ্ছে এই সার। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে জাতীয় পদক পাওয়া সৈয়দপুরের কৃষি উদ্যোক্তা আহসানুল হক তাঁর ড্রাগন ফলের বাগানসহ অন্যান্য খামারে ব্যবহার করছেন এ সার। ফলনও পাচ্ছেন ভালো। তিনি এ পর্যন্ত আড়াই টন সার কিনেছেন।

এ সার ব্যবহারে মাঠপর্যায়ে সচেতনতামূলক কাজ করছে সমাজকল্যাণ সংস্থা (এসকেএস) ফাউন্ডেশন। সংস্থার প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর নজরুল ইসলাম তপাদার বলেন, এই সার সৈয়দপুরের ১৩২টি পারিবারিক পুষ্টিবাগান ও ৭৪ জন কৃষক ব্যবহার করছেন। বছরে এ প্ল্যান্ট থেকে ৩৭৯ টন সার উৎপাদন সম্ভব। এখন পর্যন্ত ৩৫ টন সার উৎপাদিত হয়েছে, এর মধ্যে প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে ২৯ টন।

সৈয়দপুর পৌর মেয়র রাফিকা আক্তার জাহান বলেন, ঢাকার মানুষ টয়লেট ফ্লাশ করার পর হয়তো জানে না যে তাদের পয়োবর্জ্য কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু সৈয়দপুরের মানুষ জানে তাদের পয়োবর্জ্য ট্যাংক থেকে প্ল্যান্টে গিয়ে সার উৎপাদন হচ্ছে।

একইভাবে টাঙ্গাইলের সখীপুর পৌরসভায় কো-কম্পোস্ট প্ল্যান্ট তৈরি করে মানববর্জ্য থেকে তৈরি করছে জৈব সার। ওয়াটারএইড বাংলাদেশের সহায়তায় ওই প্ল্যান্ট থেকে বছরে উৎপাদিত হচ্ছে ২৪ টন। এই সারের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সখী কম্পোস্ট’। পৌরসভার ৫৮ শতাংশ মানববর্জ্য নিরাপদভাবে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে।

কৃষি উদ্যোক্তা আহসানুল হক তাঁর ড্রাগন ফলের বাগানসহ অন্যান্য খামারে ব্যবহার করছেন এ সার
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) গবেষণায় জানিয়েছে, এ জৈব সারে কোনো ক্ষতিকারক জীবাণু নেই, বরং কৃষিজমিতে পুষ্টিগুণ বেড়েছে। উৎপাদনও লাভজনক। জমিতে ব্যবহার করলে মাটি বিষাক্ত হয় না, মাটির গুণ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, বর্জ্য নিয়ে সভ্য দুনিয়ায় এখন দুটি কথা খুব চালু আছে। প্রথমটি—‘আজকের বর্জ্য আগামীকালের সম্পদ’। দ্বিতীয়টি—‘আবর্জনাই নগদ অর্থ’। সৈয়দপুরে তৈরি সার সম্পূর্ণ প্যাথোজেনমুক্ত বলে তা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না।