আরব বেদুইনদের লাইলি-মজনু, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের রোমিও-জুলিয়েট কিংবা ভারতের বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের রাধা–কৃষ্ণের প্রেমগাথা দেশকাল পেরিয়ে আজও মানুষকে আকুল করে। প্রেমের তেমনই এক অমর চাকমা প্রেমগাথা রাধামন-ধনপুদির পালা।
রাধামন-ধনপুদি পালাটি পরিবেশন করেন মূলত গেংখুলি নামে পরিচিত চাকমা পালাকারেরা। পালাটি বেশ দীর্ঘ। নানা পর্বে টানা সাত দিন সাত রাত ধরে এটি গাওয়া হয়। এরপরও নাকি এটি শেষ হয় না। লিখিত কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ না থাকায় একেক পালাকারের হাতে এর কাহিনি বদলে যায়। কারও পরিবেশনায় এ কাহিনি মধুর মিলনে শেষ হয়, কারও গাথায় তীব্র বিচ্ছেদের বেদনায় এর সমাপ্তি ঘটে। পালাজুড়ে রাধামন আর ধনপুদির নানা বয়সের প্রেম-বিরহ আর মান-অভিমান নিয়ে থাকে আলাদা আলাদা পর্ব।
অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, পালাটি রচিত হয়েছে ৬০০ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। কেউ কেউ আবার বলেন, এর রচনাকাল খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে।
চাকমাদের আদি রাজ্য চম্পকনগরের রাজা সাংবুদ্ধর ছেলে বিজয়গিরির সেনাপতি ছিলেন রাধামন। মগরাজ্য ও চাদিগাং (চট্টগ্রাম) যুদ্ধযাত্রার সময় রাধামন অসম্ভব সাহসের পরিচয় দেন। চাকমা সমাজে এখনো তিনি বীর। এই রাধামনের প্রেমগাথা নিয়েই এই পালা।
রাধামন–ধনপুদির আরেকটি সম্প্রসারিত উপাখ্যান চাদিগাং ছাড়া পালা। এটি রাধামন–ধনপুদি পালারই দ্বিতীয় অংশ। এটিও অনেক পর্বে বিভক্ত। এটি রাজা বিজয়গিরির নেতৃত্বে সেনাপতি রাধামনের অক্সাদেশ বা রোসাং, কাঞ্চনপুর ও কালাঞ্জর বা কুকি রাজ্য জয় এবং যুদ্ধশেষে বাড়ি ফিরে আসার এর কাহিনি।
চাকমা ভাষার গবেষক সুগত চাকমা এবং মৃত্তিকা চাকমার একাধিক লেখায় রাধামন-ধনপুদি পালার গল্পটি পাওয়া যায়। তবে গেংখুলি পালাকারদের সামনে বসে এই পালা না উপভোগ না করলে এর পরিপূর্ণ রসের স্বাদ কারও পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়। মূল গল্পটি তবু বলা যাক।
চাকমাদের আদি নিবাস চম্পকনগরের প্রত্যন্ত এক পাহাড়ি গ্রাম ছিল ধনপাদা। গ্রামটি ছিল ধনে–জনে পরিপূর্ণ। সেখানে থাকত ৬ কুড়ি বা ১২০টি পাহাড়ি পরিবার। গ্রামের সব বাড়িই ছিল মাচাংঘর। গেংখুলিদের গানে ছয় কুড়ি গৃহস্থের গ্রামকে সমৃদ্ধ গ্রাম বা ‘ভরন্ধি আদাম’ বলা হয়। সমৃদ্ধ সেই গ্রামে মেনকা আর কপুদি নামে দুই বোন বাস করত। দুজনারই বিয়ে হয়েছিল অবস্থাপন্ন পরিবারে।
মেনকার স্বামী জয়মঙ্গল, কপুদির নীলগিরি। জয়মঙ্গল অবস্থাপন্ন তো ছিলেনই, তাঁদের পরিবারের প্রতিপত্তিও ছিল যথেষ্ট। মেনকার ছেলে রাধামন, কপুদির মেয়ে ধনপুদি। রাধামন ধনপুদির চেয়ে এক বছরের বড়। একই নানা-নানির কাছে বড় হয়ে ওঠে দুজন। দুজনকে একই দোলনায় রেখে ঘুমপাড়ানি ‘অলিদাগনি’ গীত গাইতেন নানি-মাসিরা।
একসঙ্গে বড় হতে লাগল দুজন। বাঁশের বাদ্যযন্ত্র খেংগড়ং আর ধুদক বাজিয়ে গান গেয়ে, ঐতিহ্যবাহী ঘিলা খেলে বা জুমখেতে কাজ করে সময় কাটত রাধামন-ধনপুদির।
এই করতে করতেই একে অপরের চোখে দেখল নিজেদের সর্বনাশ। প্রথাবিরোধী এই প্রেম সবার অলক্ষ্যে বেড়ে উঠে জানাও হয়ে গেল সবার। ধনপুদির মা–বাবা আত্মসম্মান রক্ষায় মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন আদিচরণের সঙ্গে। মা-বাবার মন রাখতে গিয়ে ধনপুদিও বিয়েতে রাজি হলো। বিয়ের রীতি অনুযায়ী ধনপুদি নদী থেকে গেল পানি আনতে। রীতি অনুযায়ী পানিভর্তি সেই কলস নিয়ে কনে যে বাড়িতে যাবে, সেটিই তার শ্বশুরবাড়ি। ধনপুদির মা–বাবার মনে ছিল সন্দেহ। তাই পানি আনতে যাওয়ার সময় ধনপুদির ওপর নজর রাখতে তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন কয়েকজন সখী। কিন্তু সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ধনপুদি গিয়ে উঠল রাধামনের বাড়ি। প্রথা ভেঙে মিলন হলো দুজনের।
তবে বাস্তবেই রাধামন–ধনপুদির মিলন হয়েছিল কি না, এ নিয়ে সন্দেহ আছে অনেক গবেষকের। চাকমা নাটক নিয়ে পিএইচডি করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ও নাট্যজন কুন্তল বড়ুয়া। তাঁর মতে, শ্রুতি আর স্মৃতিতে টিকে থাকা রাধামন-ধনপুদির কাহিনি একেকজন পালাকার একেকভাবে পরিবেশন করেন। এই পালা মূলত বিষাদগীতি। তাই বিরহই এর মূল উপজীব্য। এ কারণে মূল কাহিনিতে রাধামন-ধনপুদির মিলন হয়েছে কি না, তা বলা যাবে না। তাঁর মতে, আদিচরণের সঙ্গে বিয়ের পর ধনপুদি চিরকাল রাধামনকেই মনে রেখেছে। তার বিচ্ছেদের বেদনাই মানুষকে যুগ যুগ ধরে আকুল করেছে।