রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার প্রয়োজনে বৈধভাবে মুঠোফোনে আড়ি পাততে নতুন একটি কারিগরি প্ল্যাটফর্ম গঠনের কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ ২০২৫-এ।
আড়ি পাততে হলে আগে থেকে অনুমোদন পাওয়া সংস্থাকে এই প্ল্যাটফর্মে অনুরোধ জানাতে হবে। আদালত বা আধা বিচারিক কাউন্সিলের অনুমোদন পেলে তবেই সংশ্লিষ্ট সংস্থা আড়ি পাততে পারবে।
তবে কোনোভাবেই রাজনৈতিক কারণে দমন–পীড়নের উদ্দেশ্যে কোনো সংস্থা আড়ি পাততে পারবে না। আর আড়ি পাতা কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রতিবছর এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের প্রস্তাবও অধ্যাদেশে করা হয়েছে।
অধ্যাদেশের চূড়ান্ত খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য খসড়াটি উঠতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
দেশে মুঠোফোনে আড়ি পাতার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন আইনজ্ঞসহ মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁদের মতে, বেআইনি বা অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে গোপনে অনুপ্রবেশ বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আড়ি পাতা গ্রহণযোগ্য নয়।
কারিগরি প্ল্যাটফর্ম
কারিগরি প্ল্যাটফর্মটির নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ‘কেন্দ্রীয় আইনানুগ ইন্টারসেপশন সাপোর্ট প্ল্যাটফর্ম (সিএলআইএসপি) ’।
প্রস্তাব অনুযায়ী, প্ল্যাটফর্মটির পরিচালনা পদ্ধতি, জনবল ও সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর আওতায় থাকবে টেলিযোগাযোগ সেবা, ভয়েস কল, বার্তা, ইন্টারনেট ট্রাফিক, সিগন্যালিং, কল ডিটেইল রেকর্ড, ইন্টারনেট প্রটোকল ডেটা রেকর্ড, ডিজিটাল লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত।
দেশে মুঠোফোনে আড়ি পাতার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন আইনজ্ঞসহ মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁদের মতে, বেআইনি বা অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে গোপনে অনুপ্রবেশ বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আড়ি পাতা গ্রহণযোগ্য নয়।
আইনানুগ ইন্টারসেপশনের উদাহরণ সারা বিশ্বেই রয়েছে। সমস্যাটা এর ব্যবহারের মধ্যে না, অপব্যবহারের মধ্যে। শুধু আইন দিয়ে এর সমাধান করা কঠিন। আইনের ফাঁক গলে মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করা হয়। নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়। সমস্যাটা আসলে চর্চার জায়গায়।অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন, পরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট
তবে ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে’ আড়ি পাতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছে সরকার। আর এই আড়ি পাতার অপব্যবহার রোধে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৯৭-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, জরুরি নয়—এমন ইন্টারসেপশন কার্যক্রম আধা বিচারিক কাউন্সিল বা আদালতের অনুমোদন ছাড়া শুরু করা যাবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এই কাউন্সিলের সভাপতি হবেন।
তবে প্রস্তাব অনুযায়ী, নাগরিকের জীবনরক্ষা বা তাৎক্ষণিক বিপদ হলে ‘সীমিত পরিসরে’ ইন্টারসেপশন শুরু করা যাবে। সে ক্ষেত্রে ইন্টারসেপশন শুরু করার ১৪ দিনের মধ্যে আধা বিচারিক কাউন্সিলের প্রত্যয়ন নিতে হবে। প্রত্যয়ন না পেলে সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারসেপশন কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনানুগ ইন্টারসেপশনের উদাহরণ সারা বিশ্বেই রয়েছে। সমস্যাটা এর ব্যবহারের মধ্যে না, অপব্যবহারের মধ্যে। শুধু আইন দিয়ে এর সমাধান করা কঠিন। আইনের ফাঁক গলে মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করা হয়। নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়। সমস্যাটা আসলে চর্চার জায়গায়।’
অপব্যবহার রোধে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে বলে উল্লেখ করেন বি এম মইনুল হোসেন। তিনি বলেন, কেন আড়ি পাতা হলো, সেই ব্যাখ্যাটা যেন পরিষ্কার থাকে। আর সেটি যেন তদারকির মধ্যে রাখা হয়।
আইনানুগ আড়ি পাতার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের নাম। এ ছাড়া পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা এই ক্ষমতা পাবে।
যেসব সংস্থা আড়ি পাততে পারবে
বিগত সময়ে কোনো প্রক্রিয়া না মেনেই আড়ি পাতার রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। এই কাঠামোয় সংশ্লিষ্টদের আড়ি পাতার ক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশাধিকারের সুযোগ রাখা হয়। তবে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে এই সুযোগ সীমিত করা হয়েছে।
আইনানুগ আড়ি পাতার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের নাম।
এ ছাড়া পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা এই ক্ষমতা পাবে।
তবে শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজ নিজ সংস্থাপ্রধানের অনুমতি এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) সরকারপ্রধানের অনুমতি নিয়ে বাহিনীর সদস্য বা বহির্দেশীয় হুমকি-সম্পর্কিত বিষয়ে ইন্টারসেপশন পরিচালনা করতে পারবে।
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে অবাধে মুঠোফোনে আড়ি পাতা, নজরদারিসহ নানা অভিযোগ ওঠে এনটিএমসির বিরুদ্ধে। গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন-সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে এনটিএমসিকে বিলুপ্ত করাসহ জনগণের ওপর বেআইনি নজরদারি বন্ধের সুপারিশ করা হয়।
বিলুপ্ত হবে এনটিএমসি
২০০৮ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মোবাইল অপারেটরদের অর্থায়নে ডিজিএফআই ভবনে ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) গঠিত হয়। ২০১৩ সালে এনএমসি পরিবর্তিত হয়ে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নামে নবরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১৪ সাল থেকে এনটিএমসি একটি স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন কার্যক্রম শুরু করে।
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে অবাধে মুঠোফোনে আড়ি পাতা, নজরদারিসহ নানা অভিযোগ ওঠে এনটিএমসির বিরুদ্ধে। গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন-সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে এনটিএমসিকে বিলুপ্ত করাসহ জনগণের ওপর বেআইনি নজরদারি বন্ধের সুপারিশ করা হয়।
প্রস্তাবিত টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশের ৯৭ ধারার গ উপধারায় বলা হয়েছে, আগের যেকোনো ইন্টারসেপশন সংস্থা বা টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার বা প্ল্যাটফর্ম বিলুপ্ত হবে। ওই সংস্থার যন্ত্রপাতি, তথ্য, সব প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, পরিকাঠামো ও সম্পদ নতুন প্ল্যাটফর্মের অধীনে স্থানান্তরিত হবে। এর বাইরে কোনো কেন্দ্রীয় বা পৃথক প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম বা সংস্থা ইন্টারসেপশন পরিচালনা করলে, তা বেআইনি বলে গণ্য হবে।
ফলে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটি পাস হলে এনটিএমসি বিলুপ্ত হয়ে সিএলআইএসপি গঠিত হবে।
বিটিআরসিতে ক্ষোভ
অধ্যাদেশের খসড়ার বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাঁরা বেশ কয়েকটি ধারার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের ৩৪ ধারার ঙ উপধারায় বলা হয়েছে, সরকার বা মন্ত্রণালয় কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।
একই ধারার জ উপধারায় বলা হয়েছে, সরকার বা মন্ত্রণালয় টেলিযোগাযোগ–সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কমিশনের কাছে ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি চাইতে পারবে।
বিটিআরসির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটির উদ্দেশ্য এই সংস্থাকে (বিটিআরসি) নিয়ন্ত্রণ করা। এটি পাস হলে কলমবিরতিতে যাওয়ার কথাও বলছেন বিটিআরসির কর্মকর্তাদের কেউ কেউ।
এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী প্রথম আলোকে বলেন, এই সংস্থার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ যদি মন্ত্রণালয়ের হাতে চলে যায়, তাহলে সেটি আর স্বাধীন কমিশন থাকবে না। বিটিআরসি তখন অধিদপ্তরের মতো কাজ করবে। কমিশনকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলে এমন অধ্যাদেশ করার সিদ্ধান্তকে ‘হঠকারী’ বলেন তিনি।