ছাগল দিয়ে হালচাষের আরেক উদাহরণ

ঢাকা ও চট্টগ্রামে উড়ালসড়কে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার আগে প্রতিবারই সতর্কবার্তা এসেছিল। কিন্তু ছোট দুর্ঘটনা বলে কেউ আমলে নেননি।

রাজধানীর উত্তরায় ১৫ আগস্ট গার্ডারচাপায় প্রাইভেট কারের পাঁচ আরোহীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। ব্যস্ত সড়কে এভাবে মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে কাজ করায় অনেক বিশেষজ্ঞ একে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলছেন। সংশ্লিষ্টদের নির্মাণকাজে অবহেলা এমন মাত্রায় ছিল যে নির্মাণকাজে সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবেষ্টনী ছিল না। এমনকি দুর্ঘটনা মোকাবিলায় তাদের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গার্ডারচাপা পড়ার পরও প্রত্যক্ষদর্শীরা গাড়ির ভেতরে কাউকে কাউকে নড়াচড়া করতে দেখেছেন। একটি শিশু বেশ কান্নাকাটি করছিল। সময়মতো তাঁদের উদ্ধার করা গেলে হয়তো কেউ কেউ বেঁচে যেতেন। কিন্তু গার্ডার এত ভারী যে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে তাঁদের মৃত্যু দেখা ছাড়া কারও কিছু করার ছিল না।

আমরা লাশের সংখ্যা দিয়ে দুর্যোগের বিচার করি। লাশ কম মানে হালকা দুর্যোগ—এই মানসিক চিন্তা ক্রমেই আমাদের জন্য কাল হয়ে উঠছে। আমাদের এসব বড় বড় প্রকল্প এমন অযোগ্য ও অদক্ষ কর্মকর্তারা চালাচ্ছেন, দেখে মনে হয় এ যেন ছাগল দিয়ে হালচাষের মতো অবস্থা।

এটি দেশের ১১তম গার্ডারধস। প্রতিবারই প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার আগে আগাম সতর্কবার্তা এসেছিল। বড় দুর্ঘটনা এড়ানোর মতো সময় পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সেই সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দেননি। ১৫ আগস্ট উত্তরায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনার আগেও তেমন আগাম সতর্কবার্তা ছিল। গত ১৫ জুলাই গাজীপুর মহানগরের চৌধুরীবাড়ি এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিআরটি প্রকল্পের ফ্লাইওভারের গার্ডার গাড়িতে করে নেওয়ার সময় কাত হয়ে পড়ে জিয়াউর রহমান (৩০) নামের এক নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যু হয়।

এর আগে ৭ জুন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় নির্মাণাধীন একটি সেতুর গার্ডার ধসে লিয়াকত হোসেন (৩৫) নামের এক শ্রমিক নিহত হন। গত বছরের ১৪ মার্চ ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার ধসে দুই চীনা নাগরিকসহ চারজন আহত হন। ক্রেনের মাধ্যমে গার্ডারটি উড়ালসড়কে বসানোর সময় সেটি ছিটকে পড়ে। এর আগে একই দিন উত্তরার আবদুল্লাহপুরে গভীর রাতে একই প্রকল্পের পিয়ার ক্যাপ নামে গার্ডারের একটি অংশ ধসে পড়ে। তবে কেউ হতাহত হয়নি।

আমরা লাশের সংখ্যা দিয়ে দুর্যোগের বিচার করি। লাশ কম মানে হালকা দুর্যোগ—এই মানসিক চিন্তা ক্রমেই আমাদের জন্য কাল হয়ে উঠছে। আমাদের এসব বড় বড় প্রকল্প এমন অযোগ্য ও অদক্ষ কর্মকর্তারা চালাচ্ছেন, দেখে মনে হয় এ যেন ছাগল দিয়ে হালচাষের মতো অবস্থা।

চট্টগ্রামে প্রথম দুর্ঘটনাকে আমলে নেয়নি কেউ

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় গার্ডারধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন। নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের গার্ডারচাপায় ১৩ জন প্রাণ হারান। এ দুর্ঘটনার আগাম বার্তা এসেছিল ওই বছরের ২৯ জুন। সেদিন কংক্রিটের গার্ডার ভেঙে পড়েছিল, তবে হতাহত ছিল না বলে কেউ বিষয়টি আমলে নেয়নি।

মালিবাগে দুর্ঘটনার আগাম ইঙ্গিত

স্মৃতি হাতড়ালে অনেকেরই মনে পড়বে, ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ রাজধানীর মালিবাগে মালিবাগ-মগবাজার উড়ালসড়কের গার্ডার ধসে স্বপন মিয়া (৪২) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। গার্ডারটি রেললাইনের ওপরে পড়ায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বন্ধ ছিল। সেদিনও গার্ডার তোলার সময় ক্রেন থেকে ছিঁড়ে পড়ে। ঠিক তার ছয় দিন আগে ৭ মার্চ সতর্কতার ঘণ্টি বেজেছিল। পিলারের ওপরে তোলার সময় ক্রেন ভেঙে উড়ালসড়কের মৌচাক-মালিবাগ অংশে একটি গার্ডার নিচে পড়ে যায়। তবে গভীর রাতে দুর্ঘটনা ঘটায় প্রাণহানি হয়নি। গণমাধ্যমের নজর এড়াতে রাতেই দ্রুত গার্ডারটি ঘটনাস্থল থেকে খানিকটা দূরে মৌচাক মোড়ের কাছে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। পরে চারদিক ঘিরে গার্ডারটি ভাঙার সময় সংবাদমাধ্যমের নজরে আসে।

মৌচাকের ওই ঘটনাটি লুকানোর চেষ্টা না করলে ১৩ মার্চ উড়ালসড়কের নির্মাণশ্রমিক স্বপনকে মরতে হতো না। দুর্ঘটনায় পলাশ (৪০) ও নূর নবী (৪০) নামের আরও দুই ব্যক্তি আহত হন। স্বপনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার কুমারপুরে। গত বছর স্বপন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে যে মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা গিয়েছিল, তার বর্ণনা এখন থাক।

সংবাদকর্মীরা বিষয়টি জানতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের কাছে গেলে তাঁদের বলা হয়েছিল, ‘বিষয়টি বুঝতে হলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আসতে হবে। সড়কে যেমন গাড়ি-ঘোড়া দুর্ঘটনার শিকার হয়, এটিও তেমনই একটি দুর্ঘটনা। এতে আমাদের করার কিছু নেই।’

সংবাদকর্মীরা পরে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সাংবাদিকদের কার্যত আল্লাহর কাছে শোকর করতে বলেন। তাঁর মতে, ‘উড়ালসড়কের এই গার্ডারটি ওপরে ওঠানোর আগেই ভেঙে গেছে। ওপরে ওঠানোর পর গাড়ি চলাচলের ভাইব্রেশনে ভাঙলে তো অনেক মানুষ হতাহত হতো।’

মৌচাকের ওই ঘটনাটি লুকানোর চেষ্টা না করলে ১৩ মার্চ উড়ালসড়কের নির্মাণশ্রমিক স্বপনকে মরতে হতো না। দুর্ঘটনায় পলাশ (৪০) ও নূর নবী (৪০) নামের আরও দুই ব্যক্তি আহত হন। স্বপনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার কুমারপুরে। গত বছর স্বপন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে যে মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা গিয়েছিল, তার বর্ণনা এখন থাক। আহতদের মধ্যে নূর নবী একটি সিমেন্ট কোম্পানির গাড়িচালক আর পলাশ প্রকৌশলী। তাঁদের কেউই এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না।

উত্তরায় দুর্ঘটনার কারণ

ফাইল ছবি

সাধারণভাবে বলা হয়, ৪০ টন ওজনের বেশি কিছু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হলে অন্তত ১০০ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেন লাগে। কিন্তু উত্তরায় ব্যবহার করা ক্রেনের ধারণক্ষমতা এতটা ছিল না। ক্রেনটির গায়ে লেখা ওজন ক্ষমতা থেকে জানা যায়, লিফটিং ক্রেনের ধারণক্ষমতা ৮০ মেট্রিক টন। সেখানে যে গার্ডার তোলা হচ্ছিল, তার ওজন কমবেশি ৭০ টন। এরপর আর কিছু বলার দরকার হয় না। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান এই প্রকল্পের ব্যয় কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০৯ শতাংশ।

সাধারণত খোলা রাস্তায় এ ধরনের গার্ডার বসানোর কাজ করার সময় রাস্তাটি বন্ধ রাখার নিয়ম। এ সময় সাময়িক যান চলাচলের বিকল্প পথ তৈরি করতে হয়। উত্তরায় বিআরটির কাজ করার সময় এসবের কিছুই করা হয়নি।

এগুলো তাৎক্ষণিক কারণ। অন্য আরও অনেক কারণ নিশ্চয়ই আছে। ঘটনার দিন ১৫ আগস্ট টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বুয়েটের একজন অধ্যাপক অভিযোগ করেছেন, তদারকের দায়িত্বে থাকা কর্তারা ‘এখন প্রকল্পের সুবিধাভোগী’। তাদের গাফিলতি যে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দুর্ঘটনা মোকাবিলার প্রস্তুতি নেই

এ ধরনের যেকোনো প্রকল্পের কাজের সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ধরে পূর্বপ্রস্তুতি রাখা হয়। অথচ ১৫ আগস্ট দুর্ঘটনার পর প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সবাইকে অসহায় বসে থাকতে দেখা গেছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, চাপাপড়া গাড়িতে শিশুসহ অন্যদের আর্তচিৎকার শোনা গেছে। আরও আগে গার্ডার সরানো গেলে হয়তো কেউ কেউ বেঁচে যেতেন। গার্ডার চাপা পড়ার পরপরই ক্রেনচালক পালিয়ে যান। বিকল্প কোনো ক্রেন এবং চালক সেখানে ছিল না।

উড়ালসড়ক নির্মাণের সময় ওই এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখা, রাস্তাঘাটের ক্ষতি হলে সেটি নির্মাণ করাসহ ঠিকাদারের বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেগুলোর কোনোটিই আমাদের দেশে করা হয় না
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন

এ ধরনের ভারী গার্ডার সরানোর কোনো যন্ত্র ফায়ার সার্ভিসের কাছেও নেই। কার কাছে আছে, সেটিও কারও জানা ছিল না। ওই দিন ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা টেলিভিশনে অন্তত তা-ই বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যবহৃত ১৫০ টন ধারণক্ষমতার ক্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর। এতে আরেকবার প্রমাণিত হলো, আমাদের অতি গর্বের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ফানুস কতটা ভুল অঙ্কে আঁকা।

বহদ্দারহাটের মামলার অভিযোগপত্র নিয়ে প্রশ্ন

চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের গার্ডারধসের ঘটনায় ১৩ জন নিহতের ঘটনায় করা মামলা এখন ভুলতে বসেছে মানুষ। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সেই মর্মান্তিক ঘটনায় চান্দগাঁও থানার তৎকালীন এসআই আবুল কালাম আজাদ ২৫ জনকে আসামি করে ঘটনার দুই দিন পর ২৬ নভেম্বর মামলা করেন। পরে অভিযোগপত্র থেকে সিডিএর তিন কর্মকর্তা, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ তিনজন এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মতিনসহ ১৮ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়। এরপর কেটে গেছে ৯ বছরের বেশি সময়। আজও শেষ হয়নি মামলার বিচার কার্যক্রম।

মালিবাগের মামলার অগ্রগতি নেই

ঘটনার পরপরই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তিনি দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। ঘটনার পরপরই দায়িত্বশীলদের এমন আশ্বাস নতুন কিছু নয়। কত আশ্বাসই তো গালভরা বুলি হয়ে ভুক্তভোগীদের অনিঃশেষ কান্না আর সমালোচকদের হাসির খোরাক হয়েছে৷

দোষীদের শাস্তি ‘হুনাস্ত দুরস্ত’ (দূরের কথা), মামলার হালহকিকত সম্পর্কে এখন আর কোনো কথা শোনা যায় না।

মালিবাগের ঘটনার পর স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেছিলেন, ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ফল্ট, লিফটিং সমস্যা, গার্ডারের নির্মাণত্রুটি বা অদক্ষ লোক ক্রেন চালানোর কারণেও এটি ভাঙতে পারে। তবে দেখতে হবে, প্রকৃতই নিম্নমানের নির্মাণের কারণে গার্ডার ভাঙল কি না। আমাদের দেশে ফ্লাইওভার নির্মাণে যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তাঁদের অধিকাংশের কোনো প্রশিক্ষণ নেই।’

মোবাশ্বের হোসেন বলেন, উড়ালসড়ক নির্মাণের সময় ওই এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখা, রাস্তাঘাটের ক্ষতি হলে সেটি নির্মাণ করাসহ ঠিকাদারের বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেগুলোর কোনোটিই আমাদের দেশে করা হয় না।

অথচ এসবের জন্য আলাদা টাকা পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজ না করেও বিল উঠিয়ে নিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে—সরকারের তদারক কর্তৃপক্ষ কীভাবে এই বিলে সই করে। তাদের যথাযথ তদারকির অভাবে এমন নিম্নমানের কাজ হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

আমরাও জানি না, কীভাবে এসব বিল অনুমোদন করা হয়, মানুষ মরে বারবার।