যে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হন না

চট্টগ্রাম নগরে রেলওয়ের বক্ষব্যাধি হাসপাতালের রোগীর শয্যাগুলো যেন পরিত্যক্তছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম নগরের সিআরবি এলাকায় পাশাপাশি দুটি হাসপাতাল। একটি রেলওয়ে হাসপাতাল। অন্যটি রেলওয়ের বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য আছেন চিকিৎসক-নার্স। আছে শয্যা, খাবার ঘর, ওষুধের দোকান। তবে যাঁদের জন্য এত আয়োজন, সেই রোগীই নেই বক্ষব্যাধি হাসপাতালটিতে। রোগীর অভাবে ৫৫ শয্যার হাসপাতালের ফটকে তালা দেওয়া থাকে সব সময়।

প্রায় চার বছর ধরে রেলওয়ের বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কোনো রোগী ভর্তি হচ্ছেন না। ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর আগে রোগী ভর্তি হলেও সংখ্যায় ছিল খুবই কম। রোগী না থাকায় এ হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের পাশের আরেকটি হাসপাতালে নিয়োজিত করা হয়েছে।

কার্যত বন্ধ এই হাসপাতাল বিশেষায়িত হাসপাতাল করার উদ্যোগ নিয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এ জন্য গত বছরের ৬ মে হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক। তবে রেলওয়ের অনাগ্রহের কারণে জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগ আর এগোয়নি।

রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের যক্ষ্মারোগের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম শহর থেকে দূরে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে যক্ষ্মা কমে আসার পর ১৯৯২ সালে হাসপাতালটি কুমিরা থেকে চট্টগ্রাম নগরের সিআরবি এলাকার রেলওয়ে হাসপাতালের পাশে স্থানান্তরিত করা হয়। এই হাসপাতালের পাশেই রয়েছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যক্ষ্মারোগের চিকিৎসা আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। এখন আর হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হয় না। এ জন্য হাসপাতালে রোগী ভর্তি হচ্ছেন না। আবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগীরাও এখানে ভর্তি হতে আস্থা পান না।

রেলওয়ের এই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোগী না থাকলেও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতালে (টিবি হাসপাতাল নামে পরিচিত) যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হন বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম নগরে রেলওয়ের বক্ষব্যাধি হাসপাতাল কার্যত বন্ধ
ছবি: প্রথম আলো

রেলওয়ের বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোগী ভর্তি না হলেও চট্টগ্রামে যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা কম নয়। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম জেলায় ১৫ হাজার ৯৯১ জন যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শিশু ছিল ৬৬৬টি। ২০২১ সালে ২০ হাজার ৮৫৭ জন রোগী শনাক্ত হয়। ২০২০ সালে শনাক্ত হয়েছিল ১৪ হাজার ১১৬ জন।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ইবনে সফি আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার কারণে এখন যক্ষ্মারোগের চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে থাকতে হয় না। আর রোগী ভর্তি না হওয়ায় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের কার্যক্রম একপ্রকার বন্ধ আছে। এ অবস্থায় হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ জনবলকে পাশের রেলওয়ে হাসপাতালে নিয়োজিত করা হয়েছে। বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জন্য কোনো ধরনের খরচ নেই।

তবে রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে যক্ষ্মারোগীদের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু রেলওয়ের বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ নেই। এ অবস্থায় মানুষ এখানে কেন চিকিৎসা নিতে আসবেন?

রেলওয়ের শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রেলের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার ব্যাপারে রেল পরিবারের সদস্যদেরই আস্থা নেই। ওখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। এসব কারণে এখানে চিকিৎসা নিতে ধীরে ধীরে এই হাসপাতাল থেকে বিমুখ হয়েছেন মানুষ। রেলের উচিত হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া। দক্ষ জনবলের ব্যবস্থা করা। যাতে মানুষের আস্থা ফেরে।

রেলওয়ের বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জন্য চিকিৎসক, নার্সসহ বিভিন্ন পদে ৫১ জন থাকার কথা। কিন্তু এখন আছেন ২২ জন। যদিও বক্ষব্যাধি হাসপাতালের কার্যক্রম না থাকায় তাঁরা পাশে অবস্থিত রেলওয়ে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালে নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড রয়েছে। এগুলো সব সময় তালা দেওয়া থাকে। পরে হাসপাতালের একজন কর্মী তালা খুলে দেওয়ার পর ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ডের মেঝে ও জিনিসপত্রে ধুলা জমেছে। শয্যাগুলোও নষ্ট হওয়ার পথে। রোগীদের জন্য পৃথক খাবার ঘর রয়েছে। কিন্তু সেখানে কোনো টেবিল-চেয়ার নেই। শৌচাগারগুলো নষ্ট। ব্যবহারের অনুপযোগী।

বক্ষব্যাধি হাসপাতাল নিয়ে রেলওয়ের এমন ভূমিকা সরকারের নীতিবিরুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি চট্টগ্রামের সদস্যসচিব চিকিৎসক সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এখন দেশকে যক্ষ্মামুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রেলওয়েরও উচিত ছিল হাসপাতালটি কার্যকর করা এবং সেখানে যাতে উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়, সেটি নিশ্চিত করা। কিন্তু তা না করে কার্যত বন্ধ করে রেখেছে। এতে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সাধারণ মানুষ চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন। চিকিৎসাসেবা নিয়ে রেলওয়ের এমন গাফিলতি মেনে নেওয়া যায় না।