অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মৃত্যুবার্ষিকীতে গোলটেবিল
জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা পরিবেশের পাশাপাশি অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ
বাস্তুতন্ত্র হারিয়ে যাচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সুস্থ পরিবেশ বিকাশের প্রক্রিয়া। জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। সুস্থভাবে বাঁচার পরিবেশ পাচ্ছে না। জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা কেবল পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যই নয়, অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। একই সঙ্গে যেটুকু টিকে আছে, তা সংরক্ষণে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন। এ জন্য তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ মোজাফ্ফর আহমদের ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকী আজ ২২ মে। এ উপলক্ষে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ মন্তব্য করেন বৈঠকের সভাপতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এম এ সাত্তার মণ্ডল।
‘পরিবেশ পুনরুদ্ধার: সময়ের প্রবাহে সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ স্মৃতি সংসদ। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সভাকক্ষে সকালে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পরিবারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক রওশন জাহান ও মেয়ে ড. সোহেলা নাজনীন। তিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো।
রওশন জাহান বলেন, তিনি দেশ ও দশের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। আজীবন সমতাভিত্তিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার সাধনা করে গেছেন। বৈঠকে উপস্থিত সবাইকে তিনি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুজনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মোজাফ্ফর আহমদ। দীর্ঘদিনের স্মৃতিচারণা করে বলেন, তাঁর সঙ্গে সহজে কথা বলা যেত, তর্ক করা যেত, যুক্তি দেওয়া যেত। যুক্তি গ্রহণযোগ্য হলে তিনি নিজের মত থেকে সরে আসতেন। এই গুণটি তাঁর মতো একজন এত বড়মাপের বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দেখা যায় না। পাশাপাশি তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টভাষী, নির্ভীক ও প্রতিবাদী মানুষ।
ইমেরিটাস অধ্যাপক নগরবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষাবিদদের মধ্যে তাঁকে এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হককে শুদ্ধতম ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের বড় সমস্যা, জনসংখ্যার তুলনায় ভূমির পরিমাণ খুবই কম। প্রতিটি ইঞ্চি জমি পরিকল্পনা করে ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে পানি এবং বায়ুর সদ্ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমরা কেবল পরিকল্পনা করি। কিন্তু কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ নিই না। ২০০৬ সালে নগর নীতিমালা করা হয়েছে। তা বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’
বুয়েটের ইমেরিটাস অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ বলেন, মোজাফ্ফর আহমদ সমস্যার সমাধান দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না, তা বাস্তবায়নে সক্রিয় প্রচেষ্টা করতেন। ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস ‘টু স্ট্রোক থ্রি–হুইলার’ নিষিদ্ধ করা তাঁর একটি সফল প্রচেষ্টা।
অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, তিনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন কিন্তু সাম্প্রদায়িক বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন না। সমাজে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার জন্য কীভাবে একটি সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা করা যায়, এটাই ছিল তাঁর ভাবনা ও কাজের বিষয়। বড় সংকটের যেমন সমাধান ভেবেছেন, তেমনি ছোট ছোট সমস্যার সমাধানের উপায়ও তাঁর জানা ছিল।
বিটিভির সাবেক উপমহাপরিচালক কামরুননেসা হাসান বলেন, অত্যন্ত মাতৃভক্ত ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ববান মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে মাতৃসেবা করতে তিনিও রাতে হাসপাতালে থাকতেন। যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁর সততা, অমায়িক ব্যবহারের কথা ভুলতে পারবেন না।
কৃষিবিদ ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, সারা দেশে যে পরিবেশ ও প্রকৃতিবিধ্বংসী কার্যক্রম চলছে, তা আগে বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যতটুকু আছে, তা সংরক্ষণ করতে হবে।
আইনবিদ ও অক্সফামের সাবেক কর্মকর্তা ফরিদ হাসান আহমেদ বলেন, তিনি ছিলেন খুবই ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ছিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতি দমন, পরিবেশ রক্ষার মতো বিষয়ের মূল সংগঠনগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন মোজাফ্ফর আহমদ। ব্যক্তিগতভাবে খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন।
বাপার নেতা মহিদুল হক খান বলেন, সমাজ পরিবর্তনে তিনি নিজেদের ভেতরে পরিবর্তন আনার ওপর জোর দিতেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফ খান বলেন, সমাজে তাঁর মতো সম্মানিত মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক বিধান চন্দ্র পাল বলেন, ব্যক্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, তিনি ছিলেন এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি সংকটকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখতেন। তাঁর প্রয়াণের দিনে তাঁর অনুপস্থিতিকেই শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে সমাজ ও পরিবেশের সংকট উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
পরিবারের পক্ষে কন্যা সোহেলা নাজনীন বলেন, পরিবেশ নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তিনি বাস্তববাদী চিন্তা করতেন। তিনি বলতেন, সব সময় আমরা জিতব না। কিন্তু জেতার জন্য চেষ্টা করতে হবে। আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয় থাকতে হবে।
প্রথম আলোর পক্ষে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক বক্তব্য দেন।