হুটহাট ঢুকে পড়লেন মেয়র, করলেন জরিমানা

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। ঢাকা, ৮ জুলাই
ছবি: প্রথম আলো

আজ শনিবার সকাল ১০টা ৫ মিনিট। গুলশান-২ নম্বরে নগর ভবনের সামনে থেকে গাড়িতে করে বের হলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। উদ্দেশ্য ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চালানো বিশেষ ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শন করা। কিন্তু মেয়র কোথায়, কোন এলাকায় যাবেন, সেটা কেউ জানেন না।

অগত্যা মেয়রের গাড়িটি অনুসরণ করে পিছু নিলেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও সাংবাদিকেরা। শুরুতেই ঘটল বিপত্তি। মেয়রের গাড়িসহ কয়েকটি গাড়ি গুলশান ২ নম্বরের ট্রাফিক সিগন্যাল পার হতে পারলেও আটকে গেল অধিকাংশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের গাড়ি। এমন পরিস্থিতিতে মেয়রের গাড়ি থেকে পিছিয়ে গেলেন অন্যরা।
কিন্তু মেয়র যাবেন কোথায়? বনানীর কোনো সড়কে নাকি মহাখালী? নাকি মগবাজারের মধুবাগ এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটির ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী যেখানে সবচেয়ে বেশি এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে। সেই জল্পনা থেকেই মেয়রের গাড়ি কোন দিকে গেছে, সেটা জানার চেষ্টা চলতে থাকল।

অবশেষে জানা গেল, মেয়রের গাড়ি মহাখালী উড়ালসড়কে উঠেছে। তাহলে গন্তব্য কি ফার্মগেটের আশপাশের অন্য কোনো এলাকা? নাকি মোহাম্মদপুর এলাকার কোনো ওয়ার্ডে যাবেন তিনি? চলতে থাকল যোগাযোগ।

অবশেষে পৌনে ১১টার দিকে দিকে মেয়রের গাড়ি ঢুকল মোহাম্মদপুর এলাকার জাপান গার্ডেন সিটিতে। গাড়ি থেকেই নেমেই মেয়র গেলেন ১ নম্বর ভবনের গাড়ি রাখার ভূগর্ভস্থ পার্কিংয়ে। সেখানে একটি জায়গায় জমে থাকা পানি ও স্তূপ করে রাখা ময়লা-আবর্জনা দেখা গেল।

এরপর মেয়র গেলেন আবাসিক এলাকার উত্তর পাশে ৬ নম্বর ভবনের পেছনের দিকে নির্মাণাধীন একটি ভবনের বেজমেন্টে। সেখানে কয়েকটি জায়গায় পানি জমে ছিল। জমা পানিতে পাওয়া গেল প্রচুর পরিমাণে এডিস মশার লার্ভা। মেয়র তখন জাপান গার্ডেন সিটি কল্যাণ সমিতিকে জরিমানা করার নির্দেশ দিলেন।

মেয়র আতিকুল ইসলামের নির্দেশে অভিযানে উপস্থিত ঢাকা উত্তর সিটির নিরীক্ষা কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এরপরে মেয়র পাশের ৭ নম্বর ভবনের বেজমেন্টে যান। সেখানেও গাড়ি ধোয়ার জমে থাকা পানিতে প্রচুর পরিমাণে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।

জাপান গার্ডেন সিটির ভূগর্ভস্থ পার্কিংয়ে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। ঢাকা, ৮ জুলাই
ছবি: প্রথম আলো

সেখানে মেয়র সাংবাদিকদের বলেন, জাপান গার্ডেন সিটি এলাকার বাসিন্দাদের জন্য মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। এখানে ভবনের বেজমেন্টে রীতিমতো মশার চাষ হচ্ছে। জাপান গার্ডেন এখন মশার গার্ডেনে পরিণত হয়েছে।

আতিকুল ইসলাম আরও বলেন, মশকনিধন কর্মীরা জাপান গার্ডেন সিটি আবাসিক এলাকার ভেতরে সাধারণত প্রবেশ করতে পারেন না। তা ছাড়া আবাসিক এলাকার প্রতিটি ফ্ল্যাট বাসা থেকে সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়। এরপরও সমিতির নেতারা এগুলো তদারক করেন না।

দুপুর ১২টার দিকে জাপান গার্ডেন সিটি এলাকা থেকে বের হন মেয়র। ততক্ষণে মেয়রের সঙ্গে যুক্ত হন ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৫–এর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী দলের সদস্যরা। আগের মতোই এবারও গন্তব্য অজানা। তাই সবাই পিছু নিলেন মেয়রের গাড়ির। আদাবরের দিকে কিছু দূর এগোনোর পরে মেয়রের গাড়ি ঢুকল শেখেরটেক এলাকার দিকে। শেখেরটেক-১২ নম্বর সড়কের একটি মোড়ে গিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন মেয়র।

আরও পড়ুন

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পথচারী ও এলাকাবাসীদের ডেঙ্গুর বিষয়ে সচেতন করেন মেয়র আতিক। পাশাপাশি এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে সিটি করপোরেশনের তৈরি প্রচারপত্র বিলি করেন। একপর্যায়ে পাশের আরেকটি নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন তিনি।

শেখেরটেক-১২ নম্বর সড়কের ১৮ নম্বর প্লটের নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টেও এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। তবে তাৎক্ষণিকভাবে ভবনমালিককে পাওয়া যায়নি। তাই ভবনটি তদারকের দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তিকে আটক রাখা হয়। পরে ভবনমালিকের প্রতিনিধি আসার পরে তাঁকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এরপর রিং রোডে বের হয়ে মেয়রের গাড়ি চলতে থাকে শ্যামলীর দিকে। শ্যামলী ক্লাব মাঠের বিপরীতে মূল সড়কের পাশে একটি ভবন নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন ভবনের সামনে থামে তাঁর গাড়ি। তবে ওই ভবনের ভূগর্ভস্থ দুটি বেজমেন্টে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মশার কোনো লার্ভা নেই। কিছু জায়গায় পানি জমে থাকতে দেখে সেগুলো সেচ দিয়ে অপসারণের নির্দেশ দেন তিনি।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে জাপান গার্ডেন সিটির ভূগর্ভস্থ পার্কিংয়ে ওষুধ ছিটাচ্ছেন সিটি করপোরেশনের এক মশকনিধন কর্মী। ঢাকা, ৮ জুলাই
ছবি: প্রথম আলো

পরে পাশেই গার্ডেন রোডের ৮/১ নম্বর ভবনের বেজমেন্টে যান তিনি। সেখানে জমে থাকা পানিতে প্রচুর পরিমাণে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। তবে ভবনটির মালিকপক্ষের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় ভবনটিকে সিলগালা করে দেওয়া হয়।

শেষে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আজ আমি কোথায় যাব, সেটা আমার কর্মকর্তারা কেউ জানতেন না। আগামী দিনগুলোতেও এভাবেই ঝটিকা অভিযানে আমি মাঠে থাকব। যেখানেই মশার লার্ভা পাওয়া যাবে, সেখানেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা অথবা নিয়মিত মামলা করা হবে।’

নগরবাসীর উদ্দেশে মেয়র বলেন, ‘আপনাদের বাসাবাড়িতে, ছাদে কিংবা চারপাশে খেয়াল রাখবেন, কোথাও পানি জমে আছে কি না। যদি জমে থাকে, তাহলে আমি বলব “তিন দিনে এক দিন, জমা পানি ফেলে দিন”। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন হতে হবে।’

এ দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, ১০টি অঞ্চলে চালানো ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে মোট ১৭টি মামলায় ১৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পুরো জুলাই মাসেই ঢাকা উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ডে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’–এর পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলবে।