রবীন্দ্রনাথের লেখাই ভরসার স্থান

জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রদীপ প্রজ্বালন অনুষ্ঠান। (বাঁ থেকে) হামীম কামরুল হক, আলম খোরশেদ, ফকরুল আলম, মফিদুল হক, সুব্রত বড়ুয়া ও লাইসা আহমদ। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডির ছায়ানট ভবন মিলনায়তনেছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার নিজস্ব ধারা রয়েছে। এখানে তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণও। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানাভাবে বিতর্কের জন্ম দেওয়া হলেও কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর লেখাই ভরসার স্থান হয়ে ওঠে আমাদের জন্য। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলনের দ্বিতীয় দিনের আয়োজনের আলোচনা অনুষ্ঠানে উঠে এল এমন মত।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডির ছায়ানট মিলনায়তনে শুরু হয় এই আলোচনা অনুষ্ঠান। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন অধ্যাপক ফকরুল আলম। ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রবন্ধে ফকরুল আলম মূলত রবীন্দ্রনাথ কতভাবে এই বাংলার মানুষের অনুভবে প্রাসঙ্গিক, সে আলোচনা করেন। এখানকার জনজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ছোটগল্প লেখার একটি প্রবাহ এনে দিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। ফকরুল আলম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—এমন একটি বিতর্ক আছে। কিন্তু সেই সময়ের চিঠিপত্র, কবির তখনকার অবস্থান—সবকিছু প্রমাণ করে এটি মিথ্যা অভিযোগ।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর যখন রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়, তখনো তাঁকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে উল্লেখ করে ফকরুল আলম বলেন, রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি মুসলমানও কম ভালোবাসেনি। গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্‌দীন, মনসুর উদদীন ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্—সবার সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের সুসম্পর্ক ছিল।

প্রাবন্ধিক আলম খোরশেদ বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’র কথা রবীন্দ্রনাথের, কিন্তু সুর আমাদের এই পূর্ব বাংলার। তাই এ গানে সব সময়ই আমাদের অধিকার থাকে।

কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে সব সময় জাতীয়তাবাদবিরোধী ছিলেন, কিন্তু নিজে জাতীয়তার জন্ম দিয়েছেন। এটা বোধ হয় তাঁর একটা পারাডক্স। তাই তাঁর যে বৈশ্বিক চিন্তা, সেটাই আসল রবীন্দ্রনাথ।

সভাপতির বক্তব্যে মফিদুল হক বলেন, পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক ও সৃজনের অনেক দিক। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে, পূর্ব বাংলার শিল্পীরা রবীন্দ্রসংগীত চর্চার একটি অন্যতম প্রধান ধারা তৈরি করেছেন, সে কথা। বাংলাদেশের প্রয়াত বরেণ্য শিল্পী ওয়াহিদুল হক, জাহেদুর রহিম ও সন্‌জীদা খাতুনের মতো শিল্পীদের রবীন্দ্রচর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসের কথা উল্লেখ করেন মফিদুল হক। আলোচনা পর্বের সঞ্চালনা করেন সংস্কৃতিজন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।

সন্ধ্যার আয়োজন

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সমবেত সংগীত পরিবেশন করেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অংশ নেওয়া শিল্পীরা
ছবি: প্রথম আলো

জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের শেষ আয়োজন ছিল সন্ধ্যায়। প্রদীপ প্রজ্বালন, রবিরশ্মি, আবৃত্তি, নৃত্যানুষ্ঠান, সংগীত আয়োজন নিয়ে সাজানো হয়েছে এ পর্ব। শিল্পী ইফফাত আরা দেওয়ান শোনালেন, ‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে’। শ্রোতারা মৌন হলেন গানে। কখনো সমবেত স্বরে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, কখনো একক কণ্ঠে শোনা গেল ‘তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে, তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না’। রবীন্দ্র সম্মেলনের আয়োজনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান পরিবেশন করেন শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, ইয়াকুব আলি খানসহ অন্য শিল্পীরা।

রবিরশ্মি পর্বে অধ্যাপক, কালি ও কলম সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, স্বপ্ন—এ সবকিছুর মধ্যে মিশে আছে। তাই দিন দিন তা আরও বেশি সম্পর্কিত হয়েছে শ্রোতার সঙ্গে।’ তিনি বলেন, ‘আমি গর্ব অনুভব করি রবীন্দ্রনাথ যে ভাষায় লিখেছেন, আমি সেই ভাষার মানুষ।’

গতকাল অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনের সকাল শুরু হয়েছিল সংগীতানুষ্ঠান দিয়ে। দুপুরে হয়েছে প্রতিনিধি সম্মেলন। এই সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সদস্যরা।

আজ শনিবার শেষ দিনে আয়োজন শুরু হবে সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলির মধ্য দিয়ে। বিকেলে হবে সমাপনী অধিবেশনে রবীন্দ্রপদক ও গুণী সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন।