পরিবেশ ও অভ্যাস দুটোর সমন্বিত প্রভাবেই দেশে ফুসফুস ক্যানসার বাড়ছে

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত বুধবার অনুষ্ঠিত হয়ছবি: প্রথম আলো

আগে যেখানে মূলত বয়স্কদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসার দেখা যেত, এখন ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণদেরও এই রোগ বাড়ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে নারীদের মধ্যেও ফুসফুস ক্যানসারের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও অভ্যাস—এ দুটির সমন্বিত প্রভাবেই দেশে ফুসফুস ক্যানসারের প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে।

এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় এ কথা বলেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম।

নভেম্বর ফুসফুস ক্যানসার সচেতনতার মাস। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে এই অনলাইন আলোচনার আয়োজন করা হয়। উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন।

এ পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘ফুসফুস ক্যানসার বার্তা’। বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যানসার রোগের কারণ, ঝুঁকি, লক্ষণ, চিকিৎসা, সচেতনতা ও প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম। পর্বটি বুধবার (২৬ নভেম্বর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি

ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান দূষণ ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করেন ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, শুধু ধূমপায়ীরাই নন, যাঁরা নিয়মিত ধোঁয়া ও দূষণের সংস্পর্শে থাকেন, তাঁরাও সমান ঝুঁকিতে আছেন। ধূমপানের পাশাপাশি আধুনিক খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত ওজন, কম শারীরিক পরিশ্রম এবং অনিয়মিত জীবনযাপনও ফুসফুস ক্যানসারের একটি বড় কারণ। পরিবেশ ও অভ্যাস—এ দুটির সমন্বিত প্রভাবেই দেশে ফুসফুস ক্যানসারের প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে।

লক্ষণ কী

ফুসফুস ক্যানসারের লক্ষণ নিয়ে জানতে চাইলে ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, শুরুতে সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো দীর্ঘস্থায়ী কাশি, যা দু-তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরেও ভালো হয় না। এর সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, কাশি থেকে রক্ত আসা, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া এবং আক্রান্ত স্থানে বুকে ব্যথা দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে মুখ বা হাত ফুলে যাওয়ার মতো উপসর্গও দেখা দেয়। নিউমোনিয়া বা অ্যাজমার কারণে সরাসরি ক্যানসার হয়, এমন প্রমাণ নেই। তবে সিওপিডির মূল কারণ যেহেতু ধূমপান, আর ধূমপানই ফুসফুস ক্যানসারের প্রধান ঝুঁকি। তাই সিওপিডির পেছনের ধূমপানের অভ্যাসই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

ফুসফুস ক্যানসার রোগের কারণ, ঝুঁকি, লক্ষণ, চিকিৎসা, সচেতনতা ও প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা

উপস্থাপক জানতে চান, ফুসফুস ক্যানসার চিকিৎসা ও স্ক্রিনিং বিষয়ে। এ প্রসঙ্গে ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ফুসফুস ক্যানসারের নিয়মিত স্ক্রিনিং এখনো বিশ্বজুড়ে প্রচলিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ থেকে ৬৫ বছর বয়সী এবং দীর্ঘদিনের ধূমপায়ী বিশেষ করে ২০ বছর ধরে প্রতিদিন এক প্যাকেট ধূমপানের ইতিহাস যাঁদের আছে, তাঁদের লো-ডোজ সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে স্ক্রিনিং করা হয়। তবে এশিয়া বা বাংলাদেশে এখনো এটি সুপারিশকৃত নয়।

ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, জেনেটিক টেস্টিং বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ, যা দুই কারণে করা হয়—রোগীর বংশগত ঝুঁকি শনাক্ত করতে এবং ক্যানসারের ড্রাইভার মিউটেশন নির্ধারণ করে টার্গেটেড থেরাপি ঠিক করতে। বাংলাদেশেই এখন এসব উন্নত পরীক্ষা ও চিকিৎসাসুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।

ফুসফুস ক্যানসারের স্টেজিং সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, মোট চারটি স্টেজ আছে। প্রাথমিক স্টেজ-১–এ অনেক ক্ষেত্রে শুধু সার্জারিতেই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। স্টেজ-২ ও ৩ থেকে পরবর্তী পর্যায়ে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি বা টার্গেটেড থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। স্টেজ-৪ রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষ্য থাকে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ এবং জীবনমান উন্নত রাখা।

চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ইমিউনোথেরাপি বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধুনিক ক্যানসার চিকিৎসা, যা রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম করে। বাংলাদেশেও এই নোবেলজয়ী চিকিৎসাপদ্ধতি এখন সহজলভ্য, যদিও ব্যয়বহুল। ইমিউনোথেরাপির আগে পিডি-এল১ টেস্ট আর টার্গেটেড থেরাপির জন্য পিসিআর বা এনজিএস টেস্টের মাধ্যমে ড্রাইভার মিউটেশন শনাক্ত করা হয়।

চিকিৎসার ফলোআপ

ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর প্রথম দুই বছর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়। তাই প্রতি তিন মাসে একবার ফলোআপ জরুরি। তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত ছয় মাস থেকে এক বছর অন্তর চেকআপ করতে হয় এবং পরবর্তী সময় আজীবন বছরে একবার ফলোআপ করা উচিত।

এ প্রসঙ্গে ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, কাশি বা রক্তসহ কাশি সব সময় ক্যানসারের নির্দেশক না হলেও মুখ বা হাত ফুলে যাওয়া কিংবা বুকে বড় রক্তনালি বন্ধ হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিলে ফুসফুস ক্যানসারের সন্দেহ বেশি থাকে।
রোগ শনাক্তে দেরি হওয়ার পেছনে রোগী ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সচেতনতার অভাবকেও একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানের শেষে ডা. সৈয়দ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, পরিবেশগত দূষণ, ধূমপান, জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও সচেতনতার ঘাটতি—সব মিলিয়েই বাংলাদেশে তরুণ ও নারীদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, যা এখনই গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করা জরুরি।