‘দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে নদী ধ্বংসে সহযোগিতার প্রবণতা আছে’
স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে নদী সংরক্ষণের পরিবর্তে ধ্বংসে সহযোগিতার প্রবণতা দেখা যায়।
‘বাংলাদেশে নদ-নদী রক্ষায় প্রতিবন্ধকতা: প্রেক্ষিত সোনাই' শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে আলোচকেরা এমন কথা বলেছেন। আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলনে আয়োজন করে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) নামের একটি সংগঠন।
সোনাই নদ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা থেকে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মাধবপুর বাজারসংলগ্ন সোনাই নদের বেশ কিছু জায়গা দখল করা হয়েছে। সেসব উচ্ছেদ না করে দখল করা স্থানের পাশ দিয়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রশাসনের এই ওয়াকওয়ে নির্মাণ সেই দখলকে বৈধতা দেবে বলেও অভিযোগ করেন বক্তারা।
এই সংবাদ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন ধরার কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সহ-আহ্বায়ক ও ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের উজানে যারা আছে, তারা নদীকে রোধ করে দিচ্ছে। খুব কষ্টের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের বন্ধুদের দেশ আমাদের ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়ায় আসতে হবে।’
শারমীন মুরশিদ বলেন, ‘হবিগঞ্জের জেলার এক জেলা প্রশাসক নদীরক্ষায় জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা যত দিন না দুর্নীতিমুক্ত হবে, যত দিন না মেরিটভিত্তিক একটা রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারব, যত দিন না সত্যি আমরা দেশকে ভালোবাসব, তত দিনে সমস্যার সমাধান হবে না।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ধরার উপদেষ্টা কমিটির সদস্য মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, তাঁর দায়িত্ব পালনের সময় জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ৬৫ হাজার নদী দখলের তালিকা নেন। এর মধ্যে ছয় মাসে নদীর প্রায় ৩০ হাজার জায়গা দখলমুক্ত করেন। তারপর নদী রক্ষা কমিশন অন্তত ৩০টি জায়গা দখলমুক্ত করেছে কি না, তা নিয়ে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন।
মুজিবুর রহমান হাওলাদার আরও বলেন, ‘নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানকে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে আমার এখানকার নদীভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন, এই নদী কোম্পানি দখল করছে কেন, নদীতে কেন বর্জ্য নিক্ষেপ করেছে? নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানকে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই দায়িত্ববোধ যাদের নেই, তাদের যদি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়, তাহলে নদী রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।’
উদ্ধার হয়ে যাওয়ার পরও নদীর দখল হওয়ার প্রসঙ্গে মুজিবুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসন প্রতিদিনই নদী দখলমুক্ত করবে। এটা তাদের নিয়মিত কাজের অংশ। এটি সমন্বয় করতে পারে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ধরার কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল। তিনি বলেন, উজানে ভারত অন্তত দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করায় শুষ্ক মৌসুমে সোনাই নদে প্রবাহ থাকে না বললেই চলে। অপর দিকে অপরিকল্পিত খনন, মাধবপুরে দখল ও দূষণের শিকার হয়ে সুন্দর এই নদ একটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। সোনাই নদ দখল করে সায়হাম ফিউচার কমপ্লেক্স নামে একটি বহুত ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সামাজিক আন্দোলন করেও তা ঠেকানো যায়নি।
লিখিত বক্তব্যে সোনাই নদ রক্ষায় বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, আন্তসীমান্ত অভিন্ন নদীর ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা লক্ষণীয়। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে নদী সংরক্ষণের পরিবর্তে নদী ধ্বংসে সহযোগিতার প্রবণতা দেখা যায়। নদীর প্রতি অবহেলায় সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং রাজনৈতিক নেতারা উভয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নদী সংরক্ষণে গণমাধ্যমসহ সামাজিক ও সরকারি নানা পর্যায়ের ইতিবাচক উদ্যোগও রয়েছে, কিন্তু তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না। নদী সংরক্ষণের জন্য গৃহীত প্রকল্পসমূহ নদীর স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেশে অন্যান্য নদী দখল হওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয় কাজ করে বলে মনে করে ধরা।
নদী দখল করে যারা বাড়ি বা কারখানা বানায়, তা বন্ধে তাদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করার পরামর্শ দেন যুক্তরাষ্ট্রের টেম্পল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ধরার উপদেষ্টা কমিটির সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ। নদী রক্ষায় আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘প্রথমেই আক্রমণ না করে, আলাপ করেও অনেক নদী দখল ঠেকানো সম্ভব।’
যুক্তরাষ্ট্রেও নদী দখলের মতো ঘটনা ঘটে উল্লেখ করে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, সিনেটররা পয়সা খেয়ে দখলের সুযোগ করে দেন। তারপরও অনেক দখল আটকে যায়। কারণ হলো, সাধারণ মানুষ আদালতে যান, তখন আটকে যায়। আমাদের দেশেও সাধারণ মানুষকে নদীর এভাবে ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
দেশের প্রচলিত পদ্ধতির মধ্যে কিছু গলদ রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা ও ধরার কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সহ–আহ্বায়ক এম এস সিদ্দিকী। তিনি বলেন, নদীর রক্ষার দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর। কিন্তু নদীর ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন।
এ সময় আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গোলাম সোবহান চৌধুরী, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী ও চুনতি রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়ক সানজিদা রহমান।