অপরাধের ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত

কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে কী করা উচিত, সেসব বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিতে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির সহায়তায় শুরু হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠান।

‘প্রমাণিত: অপ্রমাণিত—আইনের সহজপাঠ’ অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

দুটি ঘটনা, দুটি মামলা। দুটি ঘটনাই ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের। এর একটিতে আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হয়; অন্যটিতে আদালতে অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি। কিন্তু কেন?

যে মামলায় আদালতে অপরাধ প্রমাণ করা গেছে, তাতে আইনগত পদক্ষেপ নিতে একদমই দেরি করেনি পরিবার। ঘটনার পরপরই ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং শরীরে থাকা আলামত সংগ্রহ করা হয়। দ্রুত মামলাও করা হয়। এরপর ঘটনাস্থল থেকে ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ করে পুলিশ।

অন্যদিকে যেটিতে অপরাধ প্রমাণিত হয়নি, সেটিতে দেখা যায় তাৎক্ষণিকভাবে ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। উল্টো বিচার চেয়ে প্রথমে স্থানীয় মাতবরদের কাছে যায় ভুক্তভোগীর পরিবার। সেখানে ‘আপস–মীমাংসার’ চেষ্টা চলে। এতে এক মাস চলে যায়। এরপর পরিবারটি আইনের আশ্রয় নিতে মামলা করে। তত দিনে ধর্ষণের সব আলামত নষ্ট হয়ে যায়।

দুটি ক্ষেত্রে একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত হলেও তা প্রমাণের ক্ষেত্রে ভিন্নতার কারণ তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক ব্যবস্থা নিতে দেরি করা। যে কারণে অনেক সময় ভুক্তভোগী ও তাঁর পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়।

সঠিক ধারণার অভাবে আইনি অধিকার থেকে সাধারণ মানুষ যাতে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ‘প্রমাণিত: অপ্রমাণিত-আইনের সহজপাঠ’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

দেশে আদালতে কোনো কিছু প্রমাণ ও অপ্রমাণের যে যাত্রা, তা অনেক ক্ষেত্রেই সুদীর্ঘ।
ওবায়দুল হাসান, প্রধান বিচারপতি

সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। আরও ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান বিচারপতি নাইমা হায়দার, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিটিভির মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা ফারাহ মামুন ও সুপ্রিম কোর্টের রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেন্স কর্মকর্তা নওরীন আক্তার।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, শিগগিরই বিটিভিতে ‘প্রমাণিত: অপ্রমাণিত-আইনের সহজপাঠ’ শীর্ষক অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। এই অনুষ্ঠানে প্রথম পাঁচ মিনিটে দেখানো হবে (নাটকের মধ্য দিয়ে) কীভাবে একটি মামলা অপ্রমাণিত হয়। পরের পাঁচ মিনিটে দেখানো হবে কীভাবে ঘটনাটি প্রমাণিত হয়। এই প্রমাণিত ও অপ্রমাণিতের বিষয়টি সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য অনুষ্ঠানে ১৫ মিনিট আলোচনা করবেন আইনজ্ঞরা। এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পক ও সংগঠক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। এই অনুষ্ঠানে সহায়তা দেবে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি।

সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ‘প্রমাণিত: অপ্রমাণিত-আইনের সহজপাঠ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের শুরুতে দুটি নাটিকা দেখানো হয়। একটি নাটিকায় দেখা যায়, উত্ত্যক্তের এক পর্যায়ে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন যুবক। ভুক্তভোগীর পরিবার ছাত্রীকে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে না নিয়ে গোসল করায়। এতে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আবার তাৎক্ষণিক মামলা না করে স্থানীয় সালিসের মাধ্যমে বিচার প্রত্যাশা করেন। এ মামলায় আদালতের রায়ে খালাস পেয়ে যান অপরাধী।

আরেকটি নাটিকায় দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার ছাত্রীকে দ্রুতই হাসপাতালে নেওয়া হয়। থানায় মামলা করতেও দেরি করেনি ভুক্তভোগীর পরিবার। ভুক্তভোগীর শরীরে ও ঘটনাস্থলে মামলার আলামত থাকায় আলাদতে অপরাধী দোষী সাব্যস্ত হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমরা যাঁরা আইনের জগতের মানুষ, সারা জীবন আইনের বইপত্র-সাময়িকী কিংবা মামলার নথিতেই যাঁদের জীবন কেটে যাচ্ছে, তাঁদের কাছেও আইন প্রায়ই দুর্বোধ্য হয়ে ধরা দেয়।’

দেশে আদালতে কোনো কিছু প্রমাণ ও অপ্রমাণের যে যাত্রা, তা অনেক ক্ষেত্রেই সুদীর্ঘ বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, ‘এই যাত্রাপথে কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার জড়িয়ে রয়েছে, তা আমাদের অনেকেই হয়তো হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে না। মাত্র ২ হাজার বিচারক ৪০ লাখের বেশি মামলা নিষ্পত্তির কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। তবু মামলাজট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই একটি মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হতে ১০–১২ বছর লেগে যায়। ইতিমধ্যে হয়তো বিচারপ্রার্থী মানুষ মামলার খরচ চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন।

দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনের বিভিন্ন দিক সহজবোধ্য করে তুলে ধরার কঠিন কাজটি কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথকে ধন্যবাদ জানান প্রধান বিচারপতি।

অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, দরিদ্র মানুষের আইনের অধিকার সরকার নিশ্চিত করেছে। প্রমাণিত: অপ্রমাণিত-আইনের সহজপাঠ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অত্যন্ত সহজ, সরল ও সাবলীলভাবে আইন, আদালত ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের সুযোগ তৈরি হবে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভুক্তভোগী মানুষ সঠিক সময় সঠিক পদ্ধতিতে অপরাধের প্রতিকার চাইতে পারবে। জনগণ হয়রানি মুক্তভাবে ন্যায়বিচার পাওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবে।

কোনো একটি বিষয়ে কথার চেয়ে দেখানো হলে মানুষের কাছে তা আরও বেশি সহজবোধ্য হয় বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, প্রমাণিত: অপ্রমাণিত-আইনের সহজপাঠ অনুষ্ঠানে আইনের কঠিন ভাষা আর জটিল প্রয়োগের বাধা পেরিয়ে সহজ-সরলভাবে তা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা থাকবে। কেউ কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভুক্তভোগীর প্রথমে কী করা উচিত, কোথায় যাওয়া উচিত—এসব তুলে ধরা হবে এই অনুষ্ঠানে। তবে এ কথা ঠিক, সঠিক বিচার না পাওয়ার ক্ষেত্রে নানাবিধ কারণ থাকে।