খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ৭০% মানুষ

ডব্লিউএফপির বাংলাদেশ বাজার তদারকি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লেও কিছুটা কমেছে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি।

দেশে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। আর মাসিক ভিত্তিতে গত এপ্রিলে এটি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে। এ অবস্থায় ৭০ শতাংশ মানুষ খাদ্যমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। তবে এপ্রিলে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।

গত সপ্তাহে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ বাজার তদারকি প্রতিবেদন–এপ্রিল ২০২৪’ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অবশ্যই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দুশ্চিন্তায় আছে; কিন্তু আমরা নিয়মিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রচুর পরিমাণে চাল-আটা বিতরণ করছি।
মো. ইসমাইল হোসেন, সচিব, খাদ্য মন্ত্রণালয়

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এপ্রিলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি এর আগের মাসের তুলনায় সামান্য (শূন্য দশমিক ৭) কমে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ হয়েছে। তবে বেড়ে গেছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এপ্রিলে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৩ দশমিক ১ শতাংশ কমে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এসব পণ্যের মূল্য সাধারণ ক্রেতা বা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের ক্রয়সীমায় আসেনি।

এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় চাল–গম বিতরণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন।

গত মার্চের তুলনায় এপ্রিলে দেশের প্রধান খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম কী পরিমাণে কমেছে বা বেড়েছে, তা–ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে ডব্লিউএফপির ওই প্রতিবেদনে। দুই–তিন মাস পরপর এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে সংস্থাটি।

সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, টানা আট মাস পর গত এপ্রিলে এলপিজির দাম সিলিন্ডারপ্রতি ৪০ টাকা কমে ১ হাজার ৪৪২ টাকা হয়। আর সাধারণ মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য চাল, গম, পাম তেল ও আলু এবং মুরগির দাম বাড়ে। কিছুটা কমে ডিম, পেঁয়াজ, মরিচ, চিনি ও সবজির দাম।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এপ্রিলে দেশে খাদ্য বাবদ মাথাপিছু খরচ হয়েছে ২ হাজার ৮৪৪ টাকা। বিশেষ করে চাল ও গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে খাদ্য বাবদ খরচ বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে খাদ্যের দাম। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে খাদ্য বাবদ মাথাপিছু খরচ ২০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৫৪৮ টাকা হয়েছে।

ডব্লিউএফপির জরিপে দেখা গেছে, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের ৬৭ শতাংশ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষ খাদ্যমূল্য নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় আছে বলে জানিয়েছে। এপ্রিলে প্রতি চারটি পরিবারের তিনটির মাসিক খরচ বেড়ে যায়। এসব পরিবারের ১০ শতাংশে ছিল কাজ করতে সক্ষম নয়, এমন সদস্য।

এতে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট, খাদ্যের উচ্চমূল্য ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি মানুষকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে; যার সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে দরিদ্র জনগণ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এপ্রিলে দেশে খাদ্য বাবদ মাথাপিছু খরচ হয়েছে ২ হাজার ৮৪৪ টাকা। বিশেষ করে চাল ও গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে খাদ্য বাবদ খরচ বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে খাদ্যের দাম। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে খাদ্য বাবদ মাথাপিছু খরচ ২০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৫৪৮ টাকা হয়েছে।

এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক সপ্তাহে দেশে সরু চালের দাম প্রায় দেড় শতাংশ বেড়ে কেজিতে ৬০ থেকে ৭৮ টাকা হয়েছে। মাঝারি ও মোটা চাল যথাক্রমে ৫২ থেকে ৫৮ টাকা ও ৪৮ থেকে ৫২ টাকায় দাঁড়িয়েছে। খোলা ও প্যাকেটজাত আটার দাম কিছুটা কমেছে। খোলা আটা ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও প্যাকেটজাত ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

খাদ্যের দাম নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তার বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অবশ্যই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দুশ্চিন্তায় আছে। কিন্তু আমরা নিয়মিতভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রচুর পরিমাণে চাল-আটা বিতরণ করছি। দেশের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই।’

চালের উৎপাদন ভালো, বেড়েছে গমের আমদানি

সরকার প্রায় ২০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিলেও দেশে গত এপ্রিল পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে। বলা হয়, চাল আমদানিতে সুবিধা দিতে সরকার গত বছরের মে মাসে আমদানি শুল্ক উঠিয়ে নেয়; কিন্তু তাতেও চাল আমদানি হয়নি।

গত বছর মূলত গমের আমদানি বেশি হয়েছে। ওই বছরের তুলনায় চলতি বছর গমের আমদানি ৯ শতাংশ বেড়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত এটি আমদানি করা হয়েছে ৫৬ লাখ টন।

খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অবশ্যই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দুশ্চিন্তায় আছে। কিন্তু আমরা নিয়মিতভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রচুর পরিমাণে চাল-আটা বিতরণ করছি। দেশের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন

অন্যদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) চলতি সপ্তাহে প্রকাশ করা ‘ওয়ার্ল্ড ফুড আউটলুক, জুন–২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, গত অর্থবছরে (২০২৩–২৪) বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইনে চালের উৎপাদন সবচেয়ে ভালো হয়েছে। বাংলাদেশে এ বছর রেকর্ড পরিমাণ ৩ কোটি ৯৫ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে; যা আগের বছরের তুলনায় ১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ গত দুই বছরের মতো এবারও তৃতীয় অবস্থানে আছে। প্রথম স্থানে রয়েছে চীন ও দ্বিতীয় স্থানে ভারত। ২০২১ সাল পর্যন্ত তৃতীয় স্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়া। এবার দেশটি ৩ কোটি ৩৭ লাখ টন চাল উৎপাদন করে চতুর্থ অবস্থানে।

খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে সরকার খোলাবাজারে চাল–আটা বিক্রি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মতো ইতিবাচক উদ্যোগগুলো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কর্মসূচির আওতায় দেওয়া খাবার কি সাধারণ বা যেসব দরিদ্র মানুষের উদ্দেশে দেওয়া হয়, তারা পাচ্ছে? এগুলো কি নিরপেক্ষ বা তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে?
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান

এফএওর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গম আমদানির বিষয়টিও উঠে এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশ আবারও গম আমদানি বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে ৭৫ লাখ টন গম আমদানি করে বাংলাদেশ এই খাদ্যশস্য আমদানিতে বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে ছিল। কোভিড–১৯ মহামারি, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ও রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর গত বছর বাংলাদেশে গম আমদানি কমে ৪৫ লাখ টনে আসে। চলতি বছর এটির আমদানি ৬০ লাখ টনে পৌঁছাতে পারে।

এফএওর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ আবার শীর্ষ ১০ গম আমদানিকারক দেশের তালিকায় ঢুকে পড়েছে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। শীর্ষ তিনে রয়েছে মিসর, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে সরকার খোলাবাজারে চাল–আটা বিক্রি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মতো ইতিবাচক উদ্যোগগুলো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কর্মসূচির আওতায় দেওয়া খাবার কি সাধারণ বা যেসব দরিদ্র মানুষের উদ্দেশে দেওয়া হয়, তারা পাচ্ছে? এগুলো কি নিরপেক্ষ বা তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে? তিনি বলেন, সরকারের উচিত, খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে বিপদে থাকা মানুষের কাছে খাদ্য দ্রুত ও সহজে সঠিকভাবে পৌঁছানোর ওপর জোর দেওয়া।