বডিক্যাম কী, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় কতটা কাজে দেবে

যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষীর শরীরে বডিক্যামফাইল ছবি: রয়টার্স

আগামী ফেব্রুয়ারিতে হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশের জন্য কমপক্ষে ৪০ হাজার বডিওয়্যার ক্যামেরা (বডিক্যাম) সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। পুলিশ সদস্যদের শরীরে এই ক্যামেরা থাকবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল সোমবার কেরানীগঞ্জে সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিটি নির্বাচনী কেন্দ্রে ভোট কীভাবে হচ্ছে, সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে কি না, সেটি দেখার জন্য থাকবে বডিক্যাম। পুলিশের কাছে এখন ১০ হাজারের মতো বডিক্যাম আছে। এমনকি কারারক্ষীদের কাছেও আছে। বিজিবির (বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) কাছে আছে। আরও ৪০ হাজার বডিক্যাম সংগ্রহের চিন্তা আছে। দেখে নেওয়া যাক এই বডিক্যাম কী, কীভাবে কাজ করে, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় কতটা কার্যকর হবে।

বডিক্যাম কী

বডিক্যামকে ‘বডি ক্যামেরা’ বা ‘বডি-ওর্ন ক্যামেরা’ নামেও ডাকা হয়। অন্যান্য ক্যামেরার মতো এতে লেন্স, স্টোরেজ (ইন্টারনাল মেমোরি বা মাইক্রোএসডি), ব্যাটারি ও রেকর্ডিং কন্ট্রোল থাকে। তবে এই ক্যামেরার বিশেষত্ব হলো, এটি মানুষের শরীরে সংযুক্ত থাকে। আকারে ছোট। এই ক্যামেরা রাখার উদ্দেশ্য হলো, সামনের দৃশ্যের ভিডিও করা।

প্রতিটি নির্বাচনী কেন্দ্রে ভোট কীভাবে হচ্ছে, সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে কি না, সেটি দেখার জন্য থাকবে বডিক্যাম। পুলিশের কাছে এখন ১০ হাজারের মতো বডিক্যাম আছে। আরও ৪০ হাজার বডিক্যাম সংগ্রহের চিন্তা আছে।
-মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

বডিক্যাম আলাদাভাবে চালানোর প্রয়োজন হয় না। সচল থাকলে তা লেন্সের আওতায় আসা সব দৃশ্য ভিডিও করে রাখে। ব্যবহারকারীর গতিবিধি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার গতিবিধিও বদলে যায়। অনেক ক্ষেত্রে বডিক্যাম অডিও রেকর্ডও করে রাখে।

বাংলাদেশে কি বডিক্যাম নতুন, কেন ব্যবহার

বডিক্যাম ব্যবহার করা বাংলাদেশ পুলিশের জন্য নতুন নয়। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ প্রথমবারের মতো বডিক্যাম ব্যবহার করতে শুরু করে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে এটি তখন চালু করা হয়।

চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল মহানগর এবং মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকেও বডিক্যাম দেওয়া হয়। বগুড়া ও কক্সবাজারের ট্রাফিক পুলিশেও পরীক্ষামূলকভাবে এ ক্যামেরার ব্যবহার চালু রয়েছে।

দেশে ভোটকেন্দ্র আছে ৪৫ হাজার। ৪০ হাজার বডিক্যাম কেনা হলে, প্রতিটি কেন্দ্রে একজন পুলিশ সদস্যকে এ ক্যামেরা দেওয়া সম্ভব হবে। কাজেই এই ক্যামেরার মাধ্যমে খুব বেশি প্রভাব তৈরি করা যাবে বলে মনে হয় না।
-আব্দুল আলীম, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য।

কেউ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করছে, এমন ঘটনার ভিডিও করে ট্রাফিক পুলিশ বিভিন্ন যানবাহন ও চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। আইন লঙ্ঘনের সময়কার ভিডিও থাকায় আইন লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি অভিযোগ অস্বীকার করতে পারেন না। আবার অনেক সময় আইন লঙ্ঘন করার পরও অনেক মানুষ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। বডিক্যাম ব্যবহার করলে আইন লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি পুলিশের ওপর চড়াও হতে পারেন না।

পুলিশ কর্মকর্তারা যাতে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে না পারেন, সেটা ঠেকানোও ছিল বডিক্যাম দেওয়ার উদ্দেশ্য। যদিও অভিযোগ আছে যে ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা অনেক সময় এ ক্যামেরা বন্ধ রাখেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বডিক্যামের ব্যবহার বাস্তবে তেমন একটা নেই।

দেশে দেশে ব্যবহার

বিশ্বের অনেক দেশে অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে বডিক্যাম ব্যবহার করা হয়। যেমন যুক্তরাজ্যের পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে এ ক্যামেরা ব্যবহার করছে। যুক্তরাজ্য মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়েবসাইটে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, উচ্চগতির যানবাহন থামানো ও তল্লাশি, কোনো সম্পত্তি কিংবা ব্যক্তিকে তল্লাশি ও গ্রেপ্তার, তদন্ত কাজসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় এ ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়।

বডিক্যামের ব্যবহার বাংলাদেশ পুলিশের জন্য নতুন নয়। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ প্রথমবারের মতো বডিক্যাম ব্যবহার করতে শুরু করে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে এটি তখন চালু করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশাল মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকেও বডিক্যাম দেওয়া হয়। বগুড়া জেলা পুলিশ ও কক্সবাজার জেলা পুলিশেও পরীক্ষামূলকভাবে এ ক্যামেরার ব্যবহার চালু রয়েছে।

ইউরোপ, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বডিক্যাম ব্যবহার করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পুলিশও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এ ক্যামেরা ব্যবহার করছে।

ভারতের দিল্লি পুলিশও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এ ক্যামেরা ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে। গত ১১ মে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়ন, স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং নাগরিকদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে বডিক্যাম ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শুরুতে দিল্লি পুলিশ ১ হাজার ৫০০ বডিক্যাম সংগ্রহ করবে। ধাপে ধাপে এ সংখ্যা বাড়ানো হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দিল্লিতে এর আগে ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২২ সালে বডিক্যাম ব্যবহারের পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে তা সফল হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের এক পুলিশ সদস্য বডিক্যাম দেখাচ্ছেন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কতটা লাভ হবে

৯ আগস্ট রাজধানী ঢাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উচ্চপর্যায়ের এক সভায় পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় বডিক্যামের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়।

এ সময় প্রধান উপদেষ্টা দ্রুত বডিক্যাম কেনা ও সেটি ব্যবহারে পুলিশ সদস্যদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার বিষয়ে নির্দেশ দেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জার্মানি, চীন ও থাইল্যান্ডের তিনটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা যাতে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে না পারেন, সেটা ঠেকানোও ছিল বডিক্যাম দেওয়ার উদ্দেশ্য। যদিও অভিযোগ আছে যে ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা অনেক সময় এ ক্যামেরা বন্ধ রাখেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বডিক্যামের ব্যবহার বাস্তবে তেমন একটা নেই।

সভায় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ৪০ হাজার বডিক্যাম সংগ্রহের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

পুলিশের অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় বডিক্যাম কতটা সফল হবে, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। দেশের পুলিশ সদস্যদের প্রযুক্তিসংক্রান্ত জ্ঞান ও দক্ষতায় ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যের প্রযুক্তিবিষয়ক দক্ষতা উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। এ কারণে পাইলট প্রকল্প বা কোনো ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগ সফল করা কঠিন হয়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন

পুলিশের এক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা ছাড়া, কোনো পাইলট প্রকল্প পরিচালনা না করেই এ ধরনের উদ্যোগ সফল হবে কি না, সেটি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা ধরে নিলে মাস ছয়েক সময় পাবে সরকার। এ সময়ের মধ্যে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। শুধু তড়িঘড়ি করে ক্যামেরা কিনলেই যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে যাবে, সেটি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।

নির্বাচনের পর এসব বডিক্যাম কীভাবে, কোন কাজে ব্যবহার করা হবে, সেই রূপরেখা তৈরি করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন পুলিশের এই ডিআইজি। তাঁর মতে, এসব ক্যামেরার অপব্যবহারের অনেক সুযোগ রয়েছে।

আরও পড়ুন

কী বলছেন বিশেষজ্ঞ

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম প্রথম আলোকে বলেন, ৪০ হাজার বডিক্যাম কেনা হলে, প্রতিটি কেন্দ্রে একজন পুলিশ সদস্যকে এই ক্যামেরা দেওয়া সম্ভব হবে। কাজেই এই ক্যামেরার মাধ্যমে খুব বেশি প্রভাব তৈরি করা যাবে বলে মনে হয় না। আবদুল আলীমের মতে, নির্বাচনের সময় পুলিশ দায়িত্ব পালন করে নির্বাচনী কেন্দ্রের বাইরে। প্রিসাইডিং অফিসার না ডাকলে পুলিশ সদস্য ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন না। ফলে এ ক্যামেরা সীমিত আকারে ব্যবহার করা যাবে।

প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি করা গেলে কোথায়, কখন, কী ঘটছে, সেটি তখনই জানা যাবে বলে মনে করেন আবদুল আলীম। বডিক্যাম দিয়ে এটা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।