দুটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ

ফারদিন হত্যার ঘটনায় এখনো জড়িতদের শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বন্ধুকে আসামি করে মামলা।

ফারদিন নূর

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর ওরফে পরশ হত্যার ঘটনায় কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর কথোপকথন ও ঘটনার দিন রামপুরা থেকে জুরাইন যাওয়ার গতিবিধি পর্যালোচনা করে দুটি কারণকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর গত সোমবার নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গত বুধবার দিবাগত রাতে বাবা কাজী নূর উদ্দিন রাজধানীর রামপুরা থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে ছেলের বন্ধু আয়াতুল্লাহ বুশরার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বুশরাকে রামপুরার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। মামলাটি গতকালই ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বুশরাকে মামলার আসামি করা প্রসঙ্গে ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, ‘তাঁর ছেলে নিখোঁজ হওয়ার আগের ছয় দিনের মেসেঞ্জার ঘেঁটে বুশরা ছাড়া আর কিছু পাবেন না। তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো প্রমাণ নেই। আমরা শুধু এতটুকু জানি, ঘটনার দিন বুশরা তাঁর ছেলের সঙ্গে ছিলেন।’

ফারহানা বলেন, ‘ঘটনার দিন ফারদিনের গায়ে কী রঙের পোশাক ছিল, ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তা বলতে পারেননি বুশরা। তাঁরা একসঙ্গে ঘুরে বেড়ালেন, খাবার খেলেন। তাহলে কেন তিনি বলতে পারলেন না—এটি আপনারা বুঝতে পারেন? আমার ছেলের সঙ্গে এত দিনের পরিচয়, তাঁর এতটুকু মায়াদয়া হলো না?’

তবে পুলিশ বলছে, হত্যার ঘটনায় এখনো মামলার প্রধান আসামি বুশরার কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করছেন। দুজনই বিতার্কিক, এই সূত্রে চার বছর ধরে ফারদিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয়।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, ৪ নভেম্বর (শুক্রবার) বেলা তিনটার দিকে ফারদিন ডেমরার কোনাপাড়ার বাসা থেকে বুয়েটের উদ্দেশ্যে বের হন। পরদিন ৫ নভেম্বর পরীক্ষা শেষে দুপুরের মধ্যে তাঁর বাসায় ফেরার কথা ছিল। পরে তাঁরা (মা-বাবা) জানতে পারেন, ফারদিন পরীক্ষা দেননি, তাঁকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষক ও সহপাঠীরা তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাচ্ছেন। বিষয়টি জেনে ৫ নভেম্বর বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁরাও মুঠোফোনে কল করে বন্ধ পান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাননি। এরপর নূর উদ্দিন রামপুরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

মামলায় উল্লেখ করা হয়, জিডির পরিপ্রেক্ষিতে রামপুরা থানা-পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বুশরা পুলিশকে বলেন, ফারদিন ৪ নভেম্বর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন। প্রথমে তাঁরা সিটি কলেজ এলাকায় দেখা করেন। সেখান থেকে নীলক্ষেত-ধানমন্ডি এলাকায় ঘোরেন। বিকেল পাঁচটার দিকে একটি রেস্তোরাঁয় খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান। রাত ১০টার দিকে তাঁর সঙ্গে রিকশায় করে রামপুরায় আসেন ফারদিন।

দুটি কারণ থাকতে পারে

ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রাজীব আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, হত্যার সম্ভাব্য দুটি কারণ ধরে অনুসন্ধান চলছে। তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে আর কিছু বলা যাচ্ছে না।

পুলিশ জানায়, ফারদিন নিখোঁজের পর তাঁর সর্বশেষ অবস্থান ছিল রাজধানীর জুরাইন। ঘটনার দিন রাত ১২টার কিছু আগে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ থাকলেও রাত ২টা পর্যন্ত অনলাইনে তাঁর মুঠোফোন থেকে বার্তা আদান-প্রদানের তথ্য রয়েছে। ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, মনে হচ্ছে তিনি ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে জুরাইনে গেছেন। কোনো টোপ বা ফাঁদে ফেলে তাঁকে জুরাইনে ডেকে নেওয়া হতে পারে। অথবা ছিনতাইকারী বা গামছা পার্টির খপ্পরেও পড়তে পারেন তিনি।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, জুরাইন থেকে ফারদিনকে নারায়ণগঞ্জে নেওয়া হয়। হত্যার পর শীতলক্ষ্যা নদীতে মরদেহ ফেলে দেওয়া হয়।

ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে পারিবারিক, সামাজিক কোনো কারণ ছিল কি না, তা-ও দেখা হচ্ছে। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই-বাছাই চলছে। আমাদের দু-তিনটি দল কাজ করছে। একটু সময় লাগবে।’

পরিবারে হতাশা

ছেলের মরদেহ উদ্ধারের তিন দিন পরও জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেন মা ফারহানা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, দেশের মেধাবী সন্তানকে হত্যা করা হলেও রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিনি তাঁদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তাহলে কেন আমার বাবার (ছেলে) শত্রুদের শনাক্ত করতে পারছেন না। কেন এত সময় লাগছে?’

ফারহানা বলেন, ‘ফারদিনকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছি। সে শুধু আমার সন্তান নয়, দেশেরও সম্পদ ছিল। আমি তো শেষ হয়ে গেছি, আমার মতো আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।’