আদালতের রায়ে ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্যসূত্র: একটি পর্যবেক্ষণ

সুপ্রিম কোর্ট
ফাইল ছবি

আদালতকে জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের দেশের মতো ‘কমন ল’ বিচারব্যবস্থায় শুধু বিচার করাই কাঙ্ক্ষিত নয়, একই সঙ্গে ন্যায়বিচার যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা প্রমাণ করারও দায় রয়েছে। বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে চলমান যেকোনো মামলার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে বিবেচ্য বিষয়ের ওপর আইন এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে বিচারকের রায়ের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অধস্তন আদালতগুলো সাধারণত যেকোনো মামলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো উদ্‌ঘাটন এবং সেগুলোর বিশ্লেষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে। উচ্চ আদালত বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের ওই ঘটনাগুলো বিবেচনায় নেওয়ার পাশাপাশি আইনি দিকগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হয়, যার প্রতিফলন প্রদত্ত রায়ে দৃশ্যমান হওয়ার কথা। উভয় ক্ষেত্রেই রায় প্রদানের সময় বিচারক যে সিদ্ধান্ত নেন, তার পেছনের কারণগুলো এবং এর সপক্ষের সূত্রগুলোর বিবরণ মামলার রায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হয় [বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮, ধারা ৩৬৭(১)]। বিবদমান পক্ষগুলো ছাড়াও আইনজীবী এবং আইনের ছাত্র–শিক্ষকদের কাছে আদালতের রায়ের গুরুত্ব অপরিসীম এবং অধিকাংশ সময় এ রায়গুলো আমাদের সংসদ প্রণীত আইনের বিধানগুলোকে বুঝতে সাহায্য করে। কোনো মামলার রায়ে বিচারকেরা যে সূত্রগুলো ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন, সেই সূত্রগুলো স্বীকৃত কোনো উৎস থেকে নেওয়ার রীতিনীতি রয়েছে। কিন্তু কোনো সূত্র নিয়ে যদি সন্দেহ থাকে, সেগুলো যদি স্বীকৃত উৎসজাত না হয় বা সেই সূত্রগুলো যদি পরবর্তী সময় খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে আদালতের সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ মানুষ ও বিচারপ্রার্থীদের মনে উদ্বেগ বা অস্বস্তি দেখা দিতে পারে, যা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায়।

প্রতীকী ছবি

ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাতেও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন সেবার ব্যবহার হচ্ছে এবং এর পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে।। ইন্টারনেট–পূর্ববর্তী সময়ে তথ্যপ্রাপ্তি যেমন সহজ ছিল না, তেমনি নির্ভরযোগ্য প্রকাশনার সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না। যে কারণে সীমিত উৎস থেকে তথ্য পাওয়া যেত এবং কিছু কিছু উৎস যুগ যুগ ধরে নিজেদের মান বজায় রেখে বিচারসংশ্লিষ্ট সবার আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। ইন্টারনেট–পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে, এই শতকের শুরু থেকে অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যের জোয়ার বইছে। এখন দুনিয়াবাসী তথ্যভারে জর্জরিত এবং মাত্রাতিরিক্ত তথ্যের ভিড়ে সঠিক এবং স্বীকৃত তথ্য খুঁজে বের করতে অনেক সময় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও হিমশিম খেতে হয়। আদালতও এর ব্যতিক্রম নয়। এর সঙ্গে রয়েছে বিচার বিভাগে লোকবলের স্বল্পতা এবং বহুগুণে বেড়েছে মামলার ধরন ও পরিমাণ। আদালতগুলোকে এখন অল্প সময়ে অনেক মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়। কাজের সুবিধার জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই আইনের জগতের লোকজনও ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্যের ব্যবহার করছে। এর অংশ হিসেবে মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সহজলভ্য ইন্টারনেট সূত্রগুলো ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন।

ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে অবশ্যই কোনো বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যেতে পারে; তবে এ ধরনের উৎস আদালতের মামলার রায়ে ব্যবহার করে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। কেননা ইন্টারনেটে পাওয়া সব তথ্যই সব সময় সঠিক হয় না। ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্যসূত্রগুলো ব্যবহার করে একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত সাধারণ কিছু নিয়মকানুন মাথায় রাখলে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকে। একাডেমিক দিক থেকে বিবেচনা করলে কোনো তথ্য কখনোই ‘জ্ঞান’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন বিশেষজ্ঞ তা অনুমোদন করেন। এ প্রক্রিয়াটি ‘পিয়ার-রিভিউ’ নামে পরিচিত।

একজন বিচারপতির লিখিত যেকোনো মামলার রায়ের বিভিন্ন ধরনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদের আলোকে উচ্চ আদালতের রায় অধস্তন আদালতে নজির হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের একাডেমিক মূল্যও অপরিসীম। একজন আইনের শিক্ষক বিভিন্ন মামলায় দেওয়া উচ্চ আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ তার গবেষণায় ব্যবহার করতে পারেন। সে জন্য বিচারকদের রায়ে স্বীকৃত সূত্রের ব্যবহার প্রত্যাশিত। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যসূত্র যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হলে আর তা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে প্রতিফলিত হলে দীর্ঘ মেয়াদে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

প্রতীকী ছবি
এএফপি

বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের ওপর মূল্য সংযোজন কর আরোপ–সম্পর্কিত একটি মামলার রায়ে হাইকোর্ট বিভাগ প্রথম একটি ওয়েবসাইটের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এরপর কমপক্ষে ২০টি মামলার রায়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে বিচারপতিরা মামলার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের এসব মামলার রায়ের কয়েকটিতে ইন্টারনেটে পাওয়া যে তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তা একাডেমিক মানদণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, কিছু রায়ে অতি সাধারণ কিছু শব্দের সংজ্ঞা, যা সহজেই স্বীকৃত ডিকশনারিতে পাওয়া যায়, সেই সংজ্ঞাগুলো ইন্টারনেট থেকে নেওয়া হয়েছে। একটা রায়ে ভিন্ন একটা দেশের একটা আইনের তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়েছে, যা সেই দেশের আইন মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে সহজেই নেওয়া যেত। কিন্তু তা না করে খুব সাধারণ একটা ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রায়ে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত কিছু কিছু ওয়েবসাইট এখন আর সচল নেই। এর ফলে এমন সন্দেহের অবকাশ থাকে যে কোনো একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই এগুলো তৈরি করা হয়েছিল এবং উদ্দেশ্য পূরণের পর সেগুলো আর কার্যকর নেই।

ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত যেসব তথ্যসূত্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মামলার রায়ে ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে একাডেমিক মহলে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয় উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫টি মামলার রায়ে তথ্যসূত্র হিসেবে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। আদালতের রায়ে ইন্টারনেট বা ক্ষেত্রবিশেষে উইকিপিডিয়ার সূত্র ব্যবহার করা যাবে কি না, তা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিতর্ক রয়েছে। মালয়েশিয়ার সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারক একবার একটি মামলার রায়ে উইকিপিডিয়ার সূত্র ব্যবহার করে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েন। ফলে সেখানে একটা অলিখিত চালু হয়েছে, আদালতের রায়ে উইকিপিডিয়ার লেখাকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষই উইকিপিডিয়ার সূত্র ব্যবহার করার বিপক্ষে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো, উইকিপিডিয়ায় যে কেউ নিজের মতো করে কোনো বিষয়ের ওপর লিখতে বা সম্পাদনা করতে পারে। বর্তমান সময়ে ব্যাপক সমালোচিত ভারতের আদানি গ্রুপকে নিয়ে উইকিপিডিয়া একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। উইকিপিডিয়া ফাউন্ডেশন দাবি করেছে, আদানি গ্রুপ টাকার বিনিময়ে ভুয়া সম্পাদক নিয়োগ করে তাদের দিয়ে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে উইকিপিডিয়ার তথ্য সম্পাদনা করে বিভিন্ন লেখা পরিবর্তন করেছে। এ ধরনের দুর্বলতার কারণেই আদালতের রায়ে উইকিপিডিয়ার তথ্যসূত্রের ব্যবহার সংগত না।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৮ সালে কমিশনার অব কাস্টমস, বেঙ্গালুরু বনাম মেসার্স এসার ইন্ডিয়া প্রা. লিমিটেড মামলায় উইকিপিডিয়ার তথ্যের সত্যতা বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নির্ভরশীলতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। এ বছরের শুরুতে ১৭ জানুয়ারি দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সুরিয়া কান্ত এবং বিক্রম নাথের সমন্বয়ের গড়া যৌথ বেঞ্চ হিউলেট প্যাকার্ড বনাম কমিশনার অব কাস্টমস এবং লেনেভো বনাম কমিশনার অব কাস্টমস—এই দুটি মামলায় রায়ে বলেছেন, যদিও ইন্টারনেটভিত্তিক উইকিপিডিয়ার মতো ‘জ্ঞানকোষ’ ব্যবহার করা সহজ এবং এগুলো সাধারণ মানুষের জানার পরিধি বিস্তারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। কিন্তু তারপরও এগুলো ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। কেননা এগুলো একাডেমিক সততার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয় এবং এগুলো ভুল তথ্য প্রচার করতে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চ আদালতের মামলার রায়ে তথ্যসূত্র হিসেবে ইন্টারনেটের ব্যবহারবিষয়ক রীতিনীতি রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো নীতিমালা নেই। কোভিড-১৯–এর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০’ নামে একটি আইন করা হয়েছে। এটি মূলত একটি মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে পক্ষগণের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আদালতকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের জন্য করা হয়েছে। আইনটিতে এ বিষয়ে কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা নেই। আইন কমিশন ২০২১ সালে ‘বিচার কার্যক্রমে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২২’ শীর্ষক একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করে। সেখানেও এ ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্যসূত্রের ব্যবহার নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ সাক্ষ্য আইনে বিশেষজ্ঞ মতামত–সম্পর্কিত বিধানে বলা আছে, তাঁকে বিশেষভাবে দক্ষ হতে হবে। আদালতের বিভিন্ন মামলার রায়ে যে তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়, সেটাকে অনেকটা বিশেষজ্ঞ মতামতের মতোই বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশে আদালতের রায়ে যদিও ইন্টারভিত্তিক তথ্যসূত্র ব্যবহারের সংখ্যা এখনো খুবই কম, কিন্তু প্রাথমিক অবস্থাতেই এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা দরকার। যেহেতু আদালত জনগণের বিচারলাভের শেষ আশ্রয়স্থল, সে কারণে তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা বাঞ্ছনীয়। আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আদালতের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘সন্দেহজনক’ কোনো তথ্যসূত্রের ব্যবহার একজন বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচারপ্রাপ্তিতে বাধা হতে পারে। এ কারণে ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যসূত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা তৈরির বিষয়ে উচ্চ আদালতকে এগিয়ে আসতে হবে।

মুহাম্মদ এরশাদুল করিম ইউনিভার্সিটি মালায়া, মালয়েশিয়ার আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক