সাহিত্যের ‘অডিও বুক’ নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে

বই বাজুক কানে– স্লোগানে মেলায় এবার প্রথম এসেছে কাহিনীক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্টলে এসেছেন বই শ্রোতারাছবি: কাহিনীক-এর সৌজন্যে

‘মজিদের বাড়িতে হাসা নিষিদ্ধ। মেয়েদের তো বটেই, কোনো মানুষের হাসি সহ্য করতে পারে না মজিদ। মজিদ খুব কঠোর প্রকৃতির লোক। কিন্তু জমিলার হাসি প্রাণখোলা।’ কথাগুলো ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিখ্যাত ‘লালসালু’ উপস্যাসের। উপন্যাসের এ পর্যায়ে মজিদ আর জমিলার মধ্যকার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আগ্রহোদ্দীপক পাঠককে যদি কোনো কাজে চটজলদি বের হতে হয়, দিনের বাকি সময়টা তাঁর অতৃপ্তিতেই কাটে।

তবে সাহিত্যপ্রেমীদের এমন অতৃপ্তি ঘোচাতে ‘অডিও বুক’ তথা শ্রুত বইয়ের অ্যাপের উদ্যোগ বাড়ছে। বইয়ের না ওলটানো পৃষ্ঠাগুলো এখন চলতি পথেই পড়ে (শুনে) নেওয়ার সুযোগ থাকছে অডিও বুকে। এবারের অমর একুশে বইমেলায় দেখা গেছে কয়েকটি অডিও বুকের স্টল। সেখানে ছিল গ্রাহকের আনাগোনাও।

উদ্যোক্তারা বলছেন, বুকশেলফ রাখার জায়গা লাগছে না, সময়স্বল্পতায়ও অপঠিত থাকছে না পাঠকপ্রিয় বইগুলো। বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ না রেখেও শুনে শুনে ঠিকই পড়া হয়ে যাচ্ছে পাঠকের। তাই এমন উদ্যোগ।

সাহিত্যে গুরুত্ব
সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য বাছাই করা বইয়ের অডিও বুক নিয়ে এসেছে ‘কাহিনীক’। এবারের বইমেলায় প্রথমবারের মতো তারা অংশ নিয়েছে। বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ শতাধিক গল্প, উপন্যাস নিয়ে সম্প্রতি যাত্রা শুরু করেছে এই শ্রুত বইয়ের অ্যাপ। এ সংগ্রহে থাকছে শুধুই বাংলা সাহিত্য। এতে স্থান পেয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং সমকালীন লেখকদের উল্লেখযোগ্য মোট ১২০টি বই।

কাহিনীকে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে খুশবন্ত সিংয়ের লেখা দেশভাগের উপন্যাস ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’। এ ছাড়া সম্প্রতি সেবা প্রকাশনীর বিভিন্ন থ্রিলার উপন্যাসও যুক্ত হয়েছে কাহিনীকের অডিও বুকে। তবে সাহিত্যকে অন্য কিছুর সঙ্গে মেলাবেন না বলে এতে শুধু উপন্যাস ও ছোটগল্পের সংগ্রহ থাকছে। অন্য কিছু এই প্ল্যাটফর্মে রাখা হচ্ছে না।

কাহিনীক ছাড়াও এবারের অমর একুশে বইমেলায় আছে ‘শুনবই’, ‘কাব্যিক’ নামের অডিও বুক অ্যাপের স্টল। দুটি প্ল্যাটফর্মই গত বছর প্রথমবার বইমেলায় অংশ নিয়েছিল।

কথা হয় শুনবইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার হৃদয়ের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁদের সংগ্রহে আছে হাজারের মতো বই। তাঁদের এখানে সাহিত্যের পাশাপাশি আছে ধর্মীয়, আত্ম–উন্নয়নমূলক বই ও বিভিন্ন অনুবাদগ্রন্থ। তাঁদের জন্য বাংলাদেশের কণ্ঠশিল্পীরা যেমন বই পড়েন, আবার ভারত থেকেও অনেকে পাঠিয়ে থাকেন।

বাংলা একাডেমি চত্বরে শুনবই সাবস্ক্রাইব করতে এসেছেন শ্রোতা
ছবি: শুনবই–এর সৌজন্যে

তরুণদের আগ্রহ বেশি
শাহরিয়ার হৃদয় বললেন, সাধারণত ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী শ্রোতারা বেশি নিচ্ছেন তাঁদের অডিও বুক। শুনবইয়ে বই কেনার সুযোগ নেই। মাসিক, ষান্মাসিক বা বাৎসরিকভাবে সাবস্ক্রাইব (গ্রাহক হওয়া) করতে হবে। সদস্য হলে যেকোনো বই শোনা যাবে।

করোনাভাইরাস মহামারির সময় মানুষ যখন ঘরবন্দী ছিল, তখন তাদের নতুন মাধ্যমে বই পড়ানোর ভাবনা থেকে শুনবই অডিও বুকের উদ্যোগ নেওয়া হয়। অল্প সময়েই অনেক সাড়া পেয়েছেন বলে জানালেন শুনবইয়ের স্টলে উপস্থিত অন্য সদস্যরা।

দ্বিতীয়বারের মতো মেলায় আসা কাব্যিকের ব্র্যান্ড এক্সিকিউটিভ সুমাইয়া জামান প্রথম আলোকে জানালেন, তাদের অ্যাপে আছে কয়েক শ বই। তবে শুধু বই নয়, আছে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্টও। ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন বলে দাবি তাঁদেরও। কাব্যিক অ্যাপের নিয়মও মাসিক সাবস্ক্রাইবের ভিত্তিতে।

তবে কাহিনীকের উদ্যোক্তারা জানান, শুধু বাংলা সাহিত্য নিয়েই তাঁদের অডিও বুক তৈরি করা। এখানকার সবগুলো বইয়ে কণ্ঠ দিচ্ছেন বাংলাদেশের শিল্পীরা। তাঁদের বই শুনতে হবে নির্দিষ্ট বইয়ের জন্য মূল্য দিয়ে। মাসিকভাবে সাবস্ক্রিপশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। অডিও বুকের মূল্য ৩১ টাকা থেকে শুরু। এ বইগুলো কিনে অন্যকে উপহার দেওয়ারও সুযোগ আছে।

জমে উঠেছে কাব্যিক অডিও বুকের স্টলও। বাংলা একাডেমি চত্বরে কাব্যিক স্টলে শ্রোতারা
ছবি: কাব্যিক–এর সৌজন্যে

কাহিনীকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ইমরাদ জুলকারনাইন প্রথম আলোকে বললেন, ‘মানুষের চেতনায় গল্প শোনার স্মৃতি আছে। দাদি–নানির মুখে যাঁরা ঠাকুরমার ঝুলি শুনে শৈশব কাটিয়েছেন, তাঁদের শুনতে ভালো লাগে অডিও বুক।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সাহিত্যের মূল্য কমাতে চাই না। তাই শ্রোতার পছন্দমতো একটি বই বেছে নেওয়ার সুযোগ রেখেই এ অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। সময় না থাকলেও মানুষ যেন বই থেকে দূরে না থাকে, তাই এ উদ্যোগ।’

মেলার মাঠে কথা হয় অডিও বুক কিনতে আসা শিক্ষার্থী রাফিয়া আলমের সঙ্গে। একাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী বললেন, তিনি বই শোনেন যানজটের মধ্যে গণপরিবহনে বসে। সময় কেটে যায় আবার বইটা পড়াও হয়ে যায়।

এ ব্যাপারে অবশ্য আরও এগিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করা যৌথ মনীষা। তিনি অনেক দিন থেকেই ইংরেজি উপন্যাস শুনে আসছেন বিদেশি অডিও বুকে।

মনীষার মা কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাতে নিয়ে বই পড়ার আনন্দ আলাদা। তবে যাঁরা বইপ্রেমী কিন্তু সময়ের জন্য পড়তে পারছেন না বা দৃষ্টি–সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের জন্য এই উদ্যোগগুলো ভালো। তবে অডিও বুক তৈরির সময় কোন পদ্ধতিতে কোন বইটি পড়া হচ্ছে সেটা যেমন বিবেচনার বিষয়, একইভাবে বইটি কেনার প্রক্রিয়াও যেন সহজ হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে।’