নিঃশব্দ মুগ্ধ মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন শাড়ি রাঙিয়ে
মাশহুন জাহান মুগ্ধর পৃথিবী নিস্তব্ধতায় ভরা। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ কিংবা রাস্তায় গাড়ির তীব্র হর্ন কোনোটিই তাঁর কানে কোনো সাড়া তোলে না। তবে শব্দহীন এক জগতে থেকেও নিজের এক জগৎ রাঙিয়ে যাচ্ছেন এই তরুণী।
সেই রং ছড়াচ্ছেন শাড়িতে; কখনো ব্লকে, কখনো তুলিতে। তাঁর ওপর ভিত্তি করেই ঢাকার সিপাহীবাগে চলছে একটি বুটিক হাউস, নাম তার মম ফানুস। মাত্র তিন কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় চলে বুটিক হাউসটি, পাঁচজন কর্মী নিয়ে। সেখানে তৈরি হয় অলকানন্দা, বনলতা, পদ্ম বা চিত্রলেখা।
মম ফানুসে যত পোশাক তৈরি হয়, তার সব কটির নকশা হয় মুগ্ধর হাতে। যে ব্লকে ছাপ দেওয়া হয়, তার নকশাগুলোও তাঁরই করা। তিনি কাগজে এঁকে দেখিয়ে দেন, সে অনুযায়ী কাঠ কেটে বানানো হয় ডায়াস। হাতে রং করা পোশাকের গায়ের প্রতিটি তুলির আঁচড় মুগ্ধ নিজে করে থাকেন।
নীরবতা আতঙ্ক
মুগ্ধর জন্ম ২০০৫ সালের অক্টোবরে। তাঁর শৈশব আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছিল মা মুশফেরা জাহানের মনে। মুগ্ধর বয়স যখন ছয় মাস, তখনই তাঁর সন্দেহ হয়েছিল, মেয়েটি হয়তো শুনতে পাচ্ছে না। চিকিৎসকেরা কথায় কষ্ট আরও বেড়ে গেল, যখন তাঁরা জানালেন, মুগ্ধ হয়তো কখনোই কথা বলতে পারবে না।
মুশফেরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওর ছোটবেলায় অন্য বাচ্চারা যখন আনন্দে চেঁচাত, আমার মেয়ে তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। এই কষ্টটা কেমন, তা শুধু একজন মা জানেন।’
২০১৪ সালে মুগ্ধ যখন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী, তখন একটি পাঞ্জাবির নকশা হাতে এঁকেছিলেন। প্রশংসিত হওয়ার পর শুরু হয় তাঁর পোশাকের নকশা করার কাজ। মুগ্ধর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাঁর মা ২০২০ সালে গড়ে তোলেন মম ফানুস বুটিক হাউস। এখন তাতেই চলছে পরিবার।
মুগ্ধর পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও হাল ছাড়েনি তারা। তিন বছর বয়সে মুগ্ধকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল ছবি আঁকার ক্লাসে। তখন তারা থাকত বগুড়ায়। বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের প্রয়াস স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল মুগ্ধকে।
মুগ্ধর জীবনের প্রথম শিক্ষক জাকিয়া সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুগ্ধ আমার সবচেয়ে কম বয়সী শিক্ষার্থী। সে ফিডার হাতে নিয়ে আসত। কখনো কখনো আমার কাছে থেকে যাওয়ার বায়না করত। ধরিয়ে দিলে সুন্দর ছবি আঁকত।’
বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী মুগ্ধ ছোটবেলা থেকেই অন্যদের ঠোঁট নড়াচড়া দেখে ভাষা বুঝতে পারতেন। জাকিয়া বলেন, ‘আমরা কথা বলার সময় অন্যজনের চোখের দিকে তাকাই। মুগ্ধ ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে কথা বুঝতে চেষ্টা করে। ওকে কাগজে রং দেখিয়ে, হাতের মুদ্রা দিয়ে আঁকার সময় নির্দেশনা বোঝাতাম।’
রং–তুলিতে সরবতা
মুগ্ধ ভালো ছবি আঁকেন ছোটবেলা থেকে। ছবি এঁকে জাতীয় পর্যায়ে অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। শিশু একাডেমির চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উদ্যাপন, বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবসসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় আয়োজনে ছবি এঁকে পুরস্কার এনেছেন মুগ্ধ।
মম ফানুসে মূলত পাইকারি হিসেবে অর্ডার নেওয়া হয়। মুগ্ধর মা অর্ডার নেওয়া, ডেলিভারি দেওয়া, হিসাব রাখার কাজটা করেন। মুগ্ধর ঝোঁক নতুন নতুন রং তৈরি, তুলিতে নকশা তুলে ধরায়, ব্লকের ডায়াস বসিয়ে সাদামাটা কাপড়কে বৈচিত্র্যময় করে তোলায়।
ছবি আঁকার শৈশবের দক্ষতাকেই তিনি কাজে লাগিয়েছেন পোশাকের নকশা আঁকায়। একবার মুগ্ধর হাতে আঁকা একটা পাঞ্জাবির নকশার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার এসেছিল একই রকম আরও ৩৩টি পাঞ্জাবি করে দেওয়ার।
ওর ছোটবেলায় অন্য বাচ্চারা যখন আনন্দে চেঁচাত, আমার মেয়ে তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। এই কষ্টটা কেমন, তা শুধু একজন মা জানেন।
ঘটনাটি ২০১৪ সালের, তখন মুগ্ধ মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। মুশফেরা বলেন, মুগ্ধ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিটি পাঞ্জাবি হাতে এঁকেছিল। সেখান থেকে শুরু হয়েছে মুগ্ধর পোশাকের নকশা করার কাজ।
মম ফানুসে প্রকাশ
মুশফেরা জাহান জানালেন, মুগ্ধর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তিনি বুটিকের দোকান শুরু করেছিলেন ২০২০ সালে। এখন দোকানটির ভরসা হচ্ছে মুগ্ধর হাতের কাজ।
মুশফেরা নিজে সেলাই প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থায়। মাসে কয়েকটি করে প্রশিক্ষণ কর্মশালা করান বিভিন্ন স্থানে।
মুগ্ধ আমার সবচেয়ে কম বয়সী শিক্ষার্থী। সে ফিডার হাতে নিয়ে আসত। কখনো কখনো আমার কাছে থেকে যাওয়ার বায়না করত। ধরিয়ে দিলে সুন্দর ছবি আঁকত।
মুশফেরা প্রথম আলোকে বলেন, মুগ্ধর বাবা একসময় বড় পদে বেসরকারি চাকরি করতেন। কোভিড মহামারির সময় থেকে তিনি আর চাকরি করেন না। মুগ্ধর বড় ভাই পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স বিভাগে। তিনি কয়েকটি টিউশনি করেন। তবে পুরো পরিবারের খরচটা আসে এখন তাঁদের বুটিক হাউস থেকে।
মম ফানুসে মূলত পাইকারি হিসেবে অর্ডার নেওয়া হয়। মুশফেরা অর্ডার নেওয়া, ডেলিভারি দেওয়া, হিসাব রাখার কাজটা করেন। মুগ্ধর ঝোঁক নতুন নতুন রং তৈরি, তুলিতে নকশা তুলে ধরায়, ব্লকের ডায়াস বসিয়ে সাদামাটা কাপড়কে বৈচিত্র্যময় করে তোলায়।
মুশফেরা জানান, মম ফানুসকে এখন বড় করার কথা ভাবছেন তাঁরা। প্রয়োজনে তাঁরা এটি ঢাকার বাইরে নিয়ে যাবেন। কারণ, জায়গা ও জনবল না বাড়ালে অর্ডার নিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।
নিঃশব্দ দাম্পত্য
মুগ্ধ এখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে এইচএসসি পড়ছেন। এই বছরেই বিয়ে হয়েছে তাঁর। তাঁর স্বামীও একই রকম শ্রবণপ্রতিবন্ধী। ফলে দুজনের আলাপ হয় ইশারা ভাষায়।
তবে মুগ্ধ তাঁর মায়ের কাছে থাকছেন; কারণ, মম ফানুস পরিচালনা করতে মায়ের সহযোগিতা তাঁর প্রয়োজন।
মুগ্ধর সঙ্গে মুঠোফোনে লিখে লিখে কথা বলতে হলো। জানতে চাইলাম অবসর সময়ে কী করতে ভালো লাগে তাঁর? উত্তর দিলেন, ইংরেজি সাবটাইটেল দেওয়া মুভি দেখতে পছন্দ করেন।
নিজের আঁকা কয়েকটি পছন্দের ছবি দেখালেন তিনি। কেন যেন চোখের ছবি নিয়ে আগ্রহ বেশি তাঁর। মানুষের নানা রকম দৃষ্টির ছবি আঁকেন তিনি।
মায়ের আফসোস, তবে মুগ্ধ মগ্ন ছবিতে
মুগ্ধর গুণ অনেককে মুগ্ধ করলেও মুশফেরার আফসোস থেকেই যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মেয়েটা এত গুণী, এত ধৈর্য ওর! মা হয়ে খুব কষ্ট হয়, যখন দেখি একটা ময়না পাখিও কথা বলতে পারে, কিন্তু আমার সন্তান কথা বলতে পারে না।’
তবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই মুগ্ধর। প্রতিদিন নতুন রং আর নকশা নিয়ে ভাবনায় বিভোর তিনি। সেই ভাবনা থেকে জন্ম হয় বনলতা, অলকানন্দা বা পদ্ম নামের সেসব শাড়ির। চলে যায় দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকানে। ক্রেতারা হয়তো জানেনও না, এক–একটি নকশায় জমে আছে এক তরুণীর সীমাবদ্ধতা ভেঙে উঠে দাঁড়ানোর গল্প।
মুগ্ধ কথা বলতে পারেন না, কিন্তু রঙের ভাষায় বলে যাচ্ছেন—আমিও পারি।