অকার্যকর রেফারেল, পথেই বছরে ৯০০ প্রসূতির মৃত্যু

দেশে রোগীর সেবায় কোনো রেফারেল পদ্ধতি নেই। বর্তমানে রেফারেলের নামে একজন চিকিৎসক রোগীর দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন। কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর পথেই ৯০০ প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।

রেফারেল পদ্ধতি নিয়ে এ মন্তব্য এবং মাতৃমৃত্যুর এই তথ্য দেওয়া হয়েছে মেটার্নাল ফিটাল মেডিসিন সোসাইটি অব বাংলাদেশের (এমএফএমএসবি) তৃতীয় আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভ ও প্রসূতি সেবা বিষয়ে দুই দিনের এই সম্মেলন আজ সোমবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেষ হয়েছে।

সম্মেলনে সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, সুইডেনের ১৬ জন বিশেষজ্ঞসহ দেশের প্রায় ৭৫০ জন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ অংশ নেন। সম্মেলনের শেষ অধিবেশন ছিল রেফারেল পদ্ধতি বিষয়ে নীতি আলোচনা।

শেষ অধিবেশনের শুরুতে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানূর রহমান চিকিৎসক, গবেষক ও বিজ্ঞানীদের কাছে ‘রেফারেল’ শব্দের বাংলা অর্থ জানতে চান। রেফারেলের গ্রহণযোগ্য বাংলা শব্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত কেউ বলতে পারেননি। আইসিডিডিআরবির এই বিজ্ঞানী ইঙ্গিত করেন যে বাংলায় গ্রহণযোগ্য শব্দ না থাকার সঙ্গে সেবা ক্ষেত্রে কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি না থাকার সম্পর্ক থাকতে পারে। এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণার ঘাটতি আছে।

অধিবেশনের সভাপতি ও আয়োজক সংগঠন এমএফএমএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফিরোজা বেগম বলেন, ‘আমাদের কোনো রেফারেল পদ্ধতি নেই। আমরা নিজের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিই। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে রোগী পাঠালাম, তিনি দায়িত্ব ঠিকমতো নিয়েছেন কি না, তা জানা যায় না।’

অনুষ্ঠানে বলা হয়, রেফারেল হচ্ছে উন্নতর ও জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য রোগীকে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর ব্যবস্থা বা পদ্ধতি। রোগীকে পাঠানোর সময় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যে প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুত থাকার বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। রোগী পাঠানো, রোগী গ্রহণ, রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা থাকতে হয়। এ নিয়ে নির্দিষ্ট বিধিবিধান বা প্রটোকল বাংলাদেশে নেই।

অবস্ট্রেটিক অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, ‘আমরা দুটি জীবন নিয়ে কাজ করি। মা ও শিশু। তাঁদের বিশেষায়িত সেবার দরকার। মা ও শিশুর জীবন বাঁচাতে রেফারেল দরকার হয়। রেফারেল কার্যকর না হলে তাঁদের জীবন বিপন্ন হয়।

রেফারেল নিয়ে সমস্যায় ভোগা নিজের বোনের জীবনের ঘটনার উদাহরণ টেনে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের আর এক সদস্য আজহারুল ইসলাম খান বলেন, অকার্যকর রেফারেল পদ্ধতির কারণে বেশি সমস্যায় ভোগেন নারীরা। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল নেই। যে জনবল আছে, তাতে দক্ষতার সমন্বয় নেই। রোগীদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এত কিছুর অনুপস্থিতিতে রেফারেল কার্যকর হয় না।

রেফারেল বিষয়কে গুরুত্বে রেখে দেশে গবেষণা হয়েছে কম। মাত্র পাঁচটি গবেষণার অস্তিত্ব আছে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়। এ প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) সভাপতি অধ্যাপক সায়েবা আখতার বলেন, রেফারেলের সমস্যা নারীর ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। ত্রুটি চিহ্নিত করে দেশে রেফারেল পদ্ধতি দাঁড় করাতে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হওয়ার দরকার। অন্যদিকে বাংলাদেশ কলেজ অব সার্জন অ্যান্ড ফিজিশিয়ানসের (বিসিপিএস) প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা চিকিৎসাশিক্ষার স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে বিষয় হিসেবে রেফারেল অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।

সরকার কী করছে, করণীয় কী

অনুষ্ঠানে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মসূচি এবং হাসপাতাল সেবা কর্মসূচি থেকে দুজন লাইন ডিরেক্টর বা বিষয়ভিত্তিক পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।

মাঠপর্যায়ে রেফারেল পদ্ধতির সমস্যা নিয়ে কথা বলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মুহাম্মদ আকরাম উল্লাহ। তিনি বলেন, রোগী রেফার করতে অ্যাম্বুলেন্স দরকার হয়, তবে অ্যাম্বুলেন্সের ঘাটতি আছে। দক্ষ জনবলের যে সমন্বয় দরকার, তারও কমতি আছে। অনেক সময় যাতায়াত ব্যয় রেফারেলের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি দাঁড় করানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। উপজেলা পর্যায়ে মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে উপজেলা থেকে রোগী জেলা পর্যায়ে পাঠানোর প্রয়োজন কম হবে।’

হাসপাতাল সেবা কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মো. জয়নাল আবেদিন বলেন, রেফারেল পদ্ধতি কার্যকর করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে ১০০ ও জেলা পর্যায়ে ৫০টি অ্যাম্বুলেন্স কেনার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া রেফারেল বিষয়ে বিধিবিধান বা প্রটোকল তৈরির উদ্যোগও আছে।

মুক্ত আলোচনায় অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা বৃদ্ধি, দক্ষ জনবল বৃদ্ধি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার, বিধিবিধান বা প্রটোকল তৈরির সুপারিশ করা হয়।

অধিবেশনের একেবারে শেষ পর্যায়ে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও মাতৃ স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ আহমেদ এহসানূর রহমান বলেন, ‘ক্রান্তিকালে, এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পথে, ঠিক স্থানে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পেরে বাংলাদেশে বছরে ৯০০ মায়ের মৃত্যু হয়। রাস্তার এই মৃত্যু কাম্য নয়।’