শাহ আবদুল করিমের গানে শান্তি মেলে

শাহ আবদুল করিম
ফাইল ছবি

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের বরাম হাওরঘেঁষা উজানধল। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কালনী নদী। করিমরচিত ছয়টি গানের বইয়ের মধ্যে এ নদীর নামেই দুটির নামকরণ—‘কালনীর ঢেউ’ আর ‘কালনীর কূলে’। এই কালনী নদীর পাড়ে থেকেই ভাটির বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম ৯৩ বছর জীবনের শেষ আট দশক কেবল গানকে আঁকড়ে ধরেই কাটিয়েছেন। করিমের জীবদ্দশায় তাঁর বাড়ির পাশের মাঠে ২০০৬ সালে চালু হওয়া শাহ আবদুল করিম লোক-উৎসবের ১৭তম আসরে যোগ দিতে এসেই দেখা হয় কাইয়ুম শাহর সঙ্গে। উজানধল মাঠে চলছিল লোক-উৎসবের মূল আয়োজন। অন্যদিকে কাইয়ুম শাহরা মুর্শিদ বাড়িতেই বসিয়েছেন গানের জলসা।

কাইয়ুম শাহর বাড়ি দিরাইয়ের কলিয়ারকাপন গ্রামে। মূলত করিমরচিত গণসংগীতই তিনি বেশি গেয়ে থাকেন। আর সুদীর্ঘ ‘ভাটির চিঠি’ গানটি তাঁর মতো দরদ দিয়ে খুব কমজনই গাইতে পারেন। তিনি ভালো একজন দোতরাবাদকও। কাইয়ুম শাহকে দেখে ফেলে আসা দিনের গল্প মনে পড়ে। তখন আবদুল করিমের বর্তমান বসতঘরের সামনেই ছিল মাটির একটা চালাঘর। সেখানে দাওয়ায় বসে এক সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো কথা হয়েছিল কাইয়ুম শাহর সঙ্গে। আলাপে আলাপে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাটির চিঠি’ গানটি হাওরাঞ্চলের এক অনবদ্য দলিল। হাওরের ইতিহাস আর জনজীবন এ গানের প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে মিশে আছে। তাঁর মতো করে আর কেউ এভাবে হাওরাঞ্চলের ইতিহাস লেখেননি।

মাঝ রাত। একটি কক্ষে গাদাগাদি করে বাউলশিল্পীরা গান গাইছেন। কারও চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু, কেউবা ত্রিপল-বিছানো মেঝেতে আছেন শুয়ে। সেখানেই এক কোণে বসে কাইয়ুম শাহ ঝিমাচ্ছেন। ডাক দিতেই আড়মোড়া ভাঙলেন। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি আচমকাই যেন ধরা দেয় তাঁর স্মরণে-মননে। তাঁর ঠোঁটের কোণে হাসি, মুখে প্রসন্নতা।

দুই হাতে আগলে ধরেন আমাকে! কত কাল পর তাঁর সঙ্গে দেখা। কমসে কম ১৪ বছর!
যে কক্ষে কাইয়ুম শাহর সঙ্গে ১৪ বছর পর দেখা হয়, সে কক্ষে ১৭ বছর আগে কাইয়ুম শুনিয়েছিলেন তাঁর মুর্শিদ বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের দ্বিপদী ছন্দে লেখা ‘ভাটির চিঠি’ নামের ৮৬৬ পঙ্‌ক্তির আখ্যান। ৮০ বছর বয়সী কাইয়ুম শাহ বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুর্শিদের গানের প্রেমে পড়েই বাউলগানে প্রবেশ। মুর্শিদের কাছে দীক্ষিত হওয়ার পর গানই তাঁর আরাধনা হয়ে পড়ে। প্রায়ই আসতেন মুর্শিদ বাড়িতে। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আবদুল করিম মারা যাওয়ার পর যাতায়াত কমে তাঁর। তবে প্রতি জন্ম-মৃত্যুতিথি মেনে কাইয়ুম চলে আসেন মুর্শিদের গ্রামের বাড়ি উজানধলে।

শাহ আবদুল করিমের শিষ্য ৮০ বছর বয়সী কাইয়ুম শাহ
ছবি: সংগৃহীত

মাটির চালাঘরের দাওয়ায় বসে আলাপের পর কাইয়ুম শাহর সঙ্গে আরও অনেকবার আলাপ হয়। সেসব আলাপে তিনি স্মৃতির চক্করে ঘুরপাক খান। তিনি শোনান তাঁর জীবনের গল্প, মুর্শিদ করিমের স্মৃতি। ৪০ বছর বয়সে মুর্শিদ ধরেছিলেন শাহ আবদুল করিমকে। এখনো করিমপ্রেমেই মজে আছেন। তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন চার বছর আগে, পরিবারে আছেন দুই ছেলে ও চার মেয়ে। নিজেও কিছু গান লিখেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘১৫ থাকি ২০টা গান নিজে লিখছি। বেশি জুইতের না! আমার গান তো কুনতাই না! তান (শাহ আবদুল করিম) গানই তো গাই সব সময়। তান গানে শান্তি মেলে।’

চলতি বছরের ৩ মার্চ লোক-উৎসবের ১৭তম আসরে যখন উজানধলে কাইয়ুম শাহর সঙ্গে আলাপ হয়, তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘মুর্শিদের কোন গুণটা আপনাকে টানত বেশি?’ কিছু না ভেবেই তাৎক্ষণিক কাইয়ুম জবাব দেন, ‘তিনি আগাগোড়া নির্লোভ মানুষ আছলা।’ পাশে থাকা করিমের আরেক শিষ্য বশিরউদ্দিন সরকার তখন জানান, প্রতি চৈত্র মাসের ১৫ তারিখ করিম তাঁর বাড়িতে ওরস পালন করতেন। পরে অবশ্য এ ওরস ১৮ ফাল্গুনে স্থানান্তরিত হয়। সে ওরসে যোগ দেওয়া ভক্ত-শিষ্যদের অনেকে মুর্শিদ করিমের হাতে ‘নজরানা’ তুলে দিতেন। ওরস শেষে যখন শিষ্য-ভক্তরা বাড়ি ফেরা শুরু করতেন, তখন আবদুল করিম তাঁর কাছে জমা হওয়া নজরানা শিষ্য-ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যেই বিলিয়ে দিতেন। এই হলো করিম, ভাটির সাধক শাহ আবদুল করিম।

গল্প শেষে কাইয়ুম শাহর কাছ থেকে বিদায় নিই। কক্ষ থেকে বের হওয়ার আগে আরও একবার বুকে আগলে নেন কাইয়ুম শাহ। বিদায়কালে তিনি অনেকটা গর্বের সঙ্গেই জানান, তাঁর মুর্শিদের লেখা অন্তত ১০০ গান এখন বাংলাভাষী মানুষের কাছে বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এসব গান মুখে মুখে ফেরে। গান লিখেই করিম অমরত্ব পেয়েছেন।

কাইয়ুম শাহ যে অমরত্বের কথা বলেছেন, এর ব্যাখ্যা করলে এটাই দাঁড়ায়—চেনা পথ বিস্মৃত হয়েছে, কত মানুষ হারিয়ে গেছে, তবে শাহ আবদুল করিম তাঁর গানের মাধ্যমে বাঙালির মণিকোঠায় থাকবেন অমলিন।