কিশোর-কিশোরীদের এক-তৃতীয়াংশ রক্তশূন্যতা ও অপুষ্টিতে ভুগছে

‘শিশু ও কিশোর স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত এবং এর নিরসনে পিএজিএসবির ভূমিকা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায়

পিএজিএসবির মহাসচিব ও স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক গুলশান আরা বলেছেন, দেশের ৩৬ মিলিয়ন কিশোর-কিশোরীর ৩ ভাগের ১ ভাগ রক্তশূন্যতা ও অপুষ্টিতে ভুগছে। ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, শতকরা ৩৫-৪০ জন খর্বাকৃতি এবং শতকরা ৩৬-৪০ জন রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। নারীদের মধ্যে শতকরা ১১ জনের বেশি পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। প্রসবজনিত জটিলতায় ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় সরকার উল্লেখযোগ্য জাতীয় কৌশল ২০১৭-২০৩০ প্রণয়ন করেছে।

‘শিশু ও কিশোর স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত এবং এর নিরসনে পিএজিএসবির ভূমিকা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এসব তথ্য তুলে ধরেন। গত সোমবার এ গোলটেবিল আলোচনা হয়।

বাংলাদেশের স্ত্রী ও প্রসূতিবিদ্যার বিশেষজ্ঞদের একটি অলাভজনক সংগঠন পেডিয়াট্রিক অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট গাইনোকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ (পিএজিএসবি)। শিশু ও কিশোর-শিক্ষা, সেবা, শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য, তাদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে সংগঠনটি বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শিশু ও কিশোর-মৃত্যুর হার কমানোর জন্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় প্রথম আন্তর্জাতিক সায়েন্টিফিক কনফারেন্সের প্রাক্কালে সোমবার এ গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পিএজিএসবির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক কোহিনুর বেগম, অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম, অধ্যাপক রওশন আরা বেগম, অধ্যাপক লায়লা আরজুমান্দ বানু, অধ্যাপক সারিয়া তাসনিম, অধ্যাপক নাজমা হক, অধ্যাপক সাবেরা খাতুন, অধ্যাপক সালেহা বেগম চোধুরী, অধ্যাপক সামিনা চৌধুরী, অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস প্রমুখ। কনফারেন্সে অংশ নেওয়া চিকিৎসকেরা শিশু ও কিশোর-স্বাস্থ্য উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী এবং সেগুলো দূরীকরণে পিএজিএসবি কী কী ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা করেন।

গোলটেবিল আলোচনার সঞ্চালক ছিলেন গুলশান আরা। শুরুতেই তিনি সায়েন্টিফিক কনফারেন্সের থিম, সোসাইটির প্রয়োজনীয়তা এবং অ্যাডোলেসেন্ট হেলথের সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। এ দেশের কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকল্পে রিসার্চ, ট্রেনিং, দেশ-বিদেশের অন্য সোসাইটির সঙ্গে মতবিনিময়, সেমিনার ইত্যাদি আয়োজন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

পিএজিএসবির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক কোহিনুর বেগম বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের সমস্যাগুলোকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন এবং সমস্যাগুলো নিরসনের মাধ্যমে সুস্থ অ্যাডোলেসেন্ট গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এরপর পিএজিএসবির উপদেষ্টা অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভুগছে।’ পিএজিএসবি সোসাইটির মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের এই সমস্যাগুলো আরও গুরুত্বসহকারে সমাধান করা যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পিএজিএসবির ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক রওশন আরা বেগম কিশোরীদের বাল্যবিবাহের নানা কারণ এবং এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ রোধের জন্য আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অবসট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক লায়লা আরজুমান্দ বানু গর্ভকালীন নানাবিধ সমস্যার কারণ হিসেবে বাল্যবিবাহ এবং অপরিকল্পিত গর্ভধারণকে চিহ্নিত করেন। তাই গণমাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে এর প্রতিকার সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ওজিএসবির এডিটর অধ্যাপক সারিয়া তাসনিম ‘কিশোরী গর্ভকালীন জটিলতা’ বিষয়ে সন্তানকে দুগ্ধ পান করানোর ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম সম্পর্কে বলেন। তিনি বলেন, ‘সন্তান জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মাতৃদুগ্ধ পান করানো শুরুর মাধ্যমে নবজাতকের মৃত্যুহার তিন–চতুর্থাংশ কমে আসতে পারে এবং একই সঙ্গে প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ পান করলে শিশু সুস্থ থাকে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নাজমা হক ‘গর্ভকালীন যত্ন’ বিষয়ে গর্ভাবস্থায় বাড়তি খাবার, প্রয়োজনে আয়রন ও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ এবং নিয়মিত চেকআপ নিশ্চিত করার ব্যাপারে জোর দেন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সহায়তা একান্ত জরুরি বলে তিনি গুরুত্বারোপ করেন।

ওজিএসবির সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক সালেহা বেগম চৌধুরী বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের খাদ্য ও পুষ্টির ওপর তাদের ভবিষ্যৎ সুস্থতা নির্ভর করে। নিয়মিত সব ধরনের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা এবং শরীরচর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ডায়েট কন্ট্রোলের ওপর নির্ভর করে নানাবিধ ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব হতে পারে, যেটা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই সুষম খাবার ও পরিমিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।’

ওজিএসবির সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক সামিনা চৌধুরী বলেন, শিশু নির্যাতন অনেক ক্ষেত্রেই শুরু হয় ঘর থেকে। কখনো ভয়ে, কখনো হুমকির কারণে এই ঘটনাগুলো শিশু-কিশোরেরা প্রকাশ করে না। কিন্তু বিভিন্নভাবে ও মানসিকভাবে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে সাইবার ক্রাইমও এখন বেড়ে চলছে। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে শিশুর পাশে থেকে চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারকেও তাদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে।

গাইনি অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে এক হাজার জনের মধ্যে তিনজনের ক্যানসারের ঝুঁকি আছে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি হতে পারে ওভারিয়ান ক্যানসার। যার মূল কারণ অল্প বয়সে বিয়ে এবং গর্ভধারণ। এ ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনেশন এবং যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে যেকোনো ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।’

এ কনফারেন্স আয়োজনের দায়িত্ব এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডকে দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল মার্কেটিং ম্যানেজার ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান পিএজিএসবির এ উদ্যোগকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানান। মানসম্পন্ন ওষুধ বাংলাদেশের জনগণের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাজারের সবচেয়ে ছোট ক্যালসিয়াম অস্টোক্যাল জিএক্স সম্পর্কেও জানানো হয় চিকিৎসকদের। পাশাপাশি একটি ভিডিও প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সের মানুষের ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়।