আমার নানি জীবনের শেষ ভোটটা দিতে পারেননি। নানির ডায়াবেটিস ছিল। গত নির্বাচনে রোদের মধ্যে হেঁটে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলেন। ভোটকেন্দ্রে ঢোকার মুখে নানিকে একজন বলেন, ‘খালা, আপনি কেন এসেছেন?’ নানি বলেছেন, ‘ভোট দিতে এসেছি।’ সেই লোক বলেন, ‘খালা, ভোট তো হয়ে গেছে। আপনার কষ্ট করে ভোট দিতে হবে না। আপনি চলে যান।’ নানিকে ভোট না দিয়েই বাড়িতে ফিরতে হয়েছে। নানি ২০২০ সালে মারা গেছেন। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার প্রথম চাওয়া, আগামী দিনে যেন এমনটা আর না ঘটে। আমরা আমাদের ভোটাধিকার ফেরত চাই। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। অনেক কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। বিদ্যমান নতুন ও পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি চাওয়া, প্রতিটি দলই সাধারণ জনগণের জন্য কাজ করুক। রাজনীতিটা শুধু দলের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জন্য হোক।
নিজের জন্য রাজনীতি করতে হলে তো প্রত্যেকেরই একটি করে রাজনৈতিক দল খোলা উচিত। বাড়ির সদস্যদের নিয়ে যে কেউ একটা রাজনৈতিক দল খুলে ফেলতে পারেন। আরেকজন হয়তো আরেকটা খুলল। তাহলে দেশে যত মানুষ ততগুলো দল হবে। আমার জন্য তখন তো আরেকজন আর কাজ করবে না। দিন শেষে আমার জন্য যে কাজ করবে আমি তাকেই ভোট দেব। আমি তো কোনো মার্কা দেখে ভোট দেব না।
অভ্যুত্থানের এক বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। তাতে ভালো আর মন্দ দুটোই আছে। তবে আমরা আরও ভালো আশা করেছি, আরও ভালো দেখতেও চাই। দেশের ক্ষমতা বদলেছে, মানুষ তো বদলায়নি। ভুলত্রুটি আমরাই করছি, খারাপ–ভালোও আমরাই করছি। দেশের মানুষকে তো আর ফেলে দেওয়া সম্ভব না। আমাদের ভেতর থেকে যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে ক্ষমতা আরও পাঁচটা বদলালেও লাভ হবে না। তবে এটা তো মানতে হবে, একটা স্বৈরাচারের অবসান ঘটেছে। সেটার জন্য আমরা তৃপ্ত। ওরা দেশের মানুষজনকে যেভাবে হত্যা করছিল, ছাত্রদের হত্যা করছিল, সেটা অবিশ্বাস্য।
তবে এখন বিশৃঙ্খলা অনেক। সরকারের সেটা শক্ত হাতে দমন করা জরুরি। সরকারকে আরও শক্ত হতে হবে। সরকারের কাছে আমরা আরও ভালো কিছু আশা করেছি। ভালো কিছু হচ্ছে না, তা নয়। তবে অনেক খারাপও হচ্ছে।
আলাদা করে প্রশাসনের কথা বলব। প্রশাসনের উচিত আমাদের সহায়তা করা। তাদের আরও বন্ধুভাবাপন্ন হতে হবে। আমরা যারা আমজনতা তারা থানায় গিয়ে কথা বলতে এখনো ভয় পাই। ব্যাপারটা এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে। পুলিশের পাত্তা পাওয়া যায় না। এটা নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেন। দেখা গেল, আপনি কোনো হুমকি পেয়েছেন, সেটা নিয়ে মামলা করতে গেলে উল্টো আপনার নামেই মামলা হয়ে যায়। আপনি কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। শুধু নামীদামি ব্যক্তিদেরই না, আমজনতাকেও যেন সহযোগিতা করা হয়। রাস্তার একটা ভিক্ষুক যেন একই রকম সহায়তা পায়। পুলিশ সহজে সাড়া দিলে সব রকম সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। প্রশাসন শক্ত হলে ছিনতাইকারী বলেন আর ধর্ষক বলেন, কারও অপরাধ করার সাহস হবে না। তারা শক্ত না হলে সবাই নিজে নিজে আইন হাতে তুলে নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে পড়বে। মানুষের সমস্যা দেখলে আমরা নিশ্চয়ই এগিয়ে যাব, প্রতিরোধ করব। কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যেই লড়াই শুরু করলে তো দেশে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে। আবার তা তো হওয়া উচিত নয়।
আমরা চাই, দেশের উন্নতি হোক। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হোক। বিগত বছরগুলোতে রাজনীতি নিয়ে কাদা–ছোড়াছুড়ি হয়েছে। সেটা না করে দেশের উন্নয়নে গঠনমূলক কাজ করা হোক। আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পে নজর দেওয়া হোক। প্রযুক্তিতে নজর দেওয়া হোক। আমরা জাপানের মতো গাড়ি, মোটরবাইক তৈরিতে মন দিই। শিল্পে এগিয়ে যেতে পারলে অনেক পরিবর্তন আপনা–আপনিই হবে। আমাদের দেশের অনেক মানুষ কষ্ট করে বিদেশে গিয়ে টাকা কামাচ্ছে, ওরাও ভালোমতো সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছে না। বিদেশে একজন মারা গেলে জায়গায় জায়গায় ঠোকর খেতে হয়। লাশটাও আনতে কষ্ট হয়ে যায়। এসবের পরিবর্তন করে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়া হোক।
এবার হিপহপ গানে ফিরি। আন্দোলনের পর হিপহপ নিয়ে শ্রোতাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। আন্দোলনের মধ্যে হিপহপে সেই সময়ের কথা উঠে এসেছিল। এখনো অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সবকিছু মিলিয়ে সময়ের পরিবর্তনটা তুলে ধরার চেষ্টা করি। শিল্পীদের প্রতি ইন্ডাস্ট্রিকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে। র্যাপারদের নিজেদের মতো করে কাজ করতে দেওয়া দরকার। শ্রোতারা হিপহপ শুনছে, হিপহপ সবাই ব্যবহারও করছে, কিন্তু হিপহপের নাম সব জায়গায় নেই। এর পরিবর্তন হওয়া দরকার।
আপাতত আমি আমার মতো করে কাজ করতে চাই। সামনে দুটি অ্যালবাম নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে ‘হুদাই হুতাশে’ শিরোনামে যে গানটি প্রকাশ করেছি, সেটা শ্রোতাদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। ‘হুদাই হুতাশে’ শব্দটা কয়েক দিন ধরে আমার মাথায় ঘুরছিল। অনেক সময় হয় না, অযথা একটা জিনিস নিয়ে মানুষ প্যারা খায়, ফাঁপর নেয়, বাটপারি করে, ঠকায়—ওই জায়গা থেকে গানটা লেখা। গানটা অভ্যুত্থানের পরের সময়ের সঙ্গে মিলে গেছে। এই সময়ে অনেক ভাঁড় দেখতে পাচ্ছি, আবার অনেক ভালো মানুষও দেখছি। সবকিছু মিলিয়ে ‘হুদাই হুতাশে’ শব্দটা মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে গেছে।
অনুলিখন: মকফুল হোসেন