নিবন্ধন ছাড়া চলছিল ২০ বছরের বেশি পুরোনো ট্রাক দুটি

সড়ক দুর্ঘটনাপ্রতীকী ছবি

বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম বগালেক সড়কে দুর্ঘটনাকবলিত দুটি ট্রাকের একটিরও নিবন্ধন নেই। এগুলো মূলত নিলামে কেনা কমপক্ষে ২০ বছরের বেশি পুরোনো গাড়ি। দুই চালকের লাইসেন্সও আছে কি নেই, তা-ও নিশ্চিত করা যায়নি। পাহাড়ে এ রকম লক্কড়ঝক্কড় পুরোনো ট্রাক ও চান্দের গাড়িতেই চলে বেশির ভাগ যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। ‘দুর্গম এলাকা, কিছু করার নেই’—এই বলে দায় এড়ায় প্রশাসন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও স্থানীয় পুলিশ।

পরিবহনমালিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবানে চলাচল করা দুই-তৃতীয়াংশ গাড়ির নিবন্ধন নেই। অনিবন্ধিত পিকআপ, মাহেন্দ্র, ট্রাক, চান্দের গাড়িযোগে প্রতিদিন রুমা, থানচি রোয়াংছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করছেন স্থানীয় লোকজন এবং পর্যটক। এ ছাড়া পণ্য পরিবহনেও ব্যবহৃত হচ্ছে এসব অবৈধ ট্রাক-পিকআপ। প্রশাসন এসব যান চলাচলের বিষয়টি অবগত।

জানতে চাইলে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্গম এলাকায় গণপরিবহন না থাকার সুযোগে কিছু অনিবন্ধিত গাড়ি চলে। বাস-অটোরিকশা সেখানে যেতে পারে না। তাই এসব গাড়ির বিকল্পও নেই।

গত সোমবার বিকেলে রুমা-বগালেক সড়কে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রাক দুটি মাঝারি আকারের। দুই ট্রাকই যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে। ঘটনার দিন দুটি ট্রাক বাগলেক থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরত্বের রুমা বাজারে যাচ্ছিল। একটি ট্রাক ছিল খালি, অপরটিতে যাত্রী ছিল অন্তত ২২ জন। যাত্রীদের বেশির ভাগ ছিলেন নারী। তাঁরা রুমা বাজারে যাচ্ছিলেন দুস্থ মহিলা উন্নয়ন (ভিজিডি) কর্মসূচির টাকা তুলতে। বাগালেক থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে এলে ঢালু রাস্তা থেকে নামার সময় খালি ট্রাকটি ধাক্কা দেয় সামনের যাত্রীবাহী ট্রাকটিকে। ফলে ট্রাকটি প্রায় ৪০ ফুট নিচের খাদে পড়ে যায়। এতে পাঁচ নারীসহ ছয়জন নিহত হন। এ ছাড়া আহত ১৬ জনের মধ্যে ১০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিরা বান্দরবানে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে কুলসুমকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, এ ধরনের গাড়িগুলো নিবন্ধনবিহীন। এগুলোর নম্বর প্লেটও ভুয়া। নিবন্ধন থাকলে ফিটনেসের বিষয় আসত। মূলত ফিটনেস চলে যাওয়া পুরোনো গাড়ি নিলামে যখন বিক্রি হয়, তখন এসব গাড়ি কিনে নেন একধরনের ব্যবসায়ী। পরে কিছুটা কাজ করে সেগুলো চলাচলের উপযোগী করে লট নম্বর দিয়ে রাস্তায় নামান।

জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক আতিয়া চৌধুরী বলেন, দুর্ঘটনায় শিকার নারীরা সবাই হতদরিদ্র ও দুর্গম এলাকার। পরিস্থিতির কারণে তাঁরা এত দিন ভিজিডি কর্মসূচির জমানো টাকা নিতে পারেননি। তাঁরা চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা পাবেন।

রুমায় দুর্ঘটনাকবলিত ট্রাক দুটির একটির নম্বর প্লেটে লেখা লট-৬৪ এবং আরেকটির নম্বর প্লেটে লেখা ঢাকা ল-২৬১। থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদমসহ বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের গাড়ির বিচরণ রয়েছে। দুর্ঘটনার পর থেকে গাড়ি দুটির চালক পলাতক রয়েছেন, যার কারণে গাড়ির মালিক সম্পর্কেও কিছু জানতে পারেনি বিআরটিএ কিংবা পুলিশ। এ ছাড়া চালকের লাইসেন্স ছিল কি না, তা-ও নিশ্চিত নয়।

বিআরটিএর বান্দরবানের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাড়ি দুটির নিবন্ধন নেই। এ ধরনের গাড়ি মাঝেমধ্যে ওই এলাকায় চলে। অন্য যানবাহন না থাকার সুযোগে এগুলো চলে। এখনো দুর্ঘটনাস্থলে যেতে পারিনি। গেলে বিস্তারিত জানা যাবে।’

গতকাল একই ধরনের কয়েকটি গাড়ি চলতে দেখা গেছে বান্দরবান শহরেও। ঢাকা-লট-১০২ নম্বর প্লেটের একটি ট্রাক প্রধান সড়ক ধরে চলে যেতে দেখা গেছে। ট্রাকটির ইঞ্জিনের ঢাকনাও নেই। একইভাবে নির্বাচন কার্যালয়ের সামনে থেকে দুটি চান্দের গাড়িকে যাত্রী তুলতে দেখা গেছে দুপুরে। তাদের একটির নম্বর প্লেটে রয়েছে ঢাকা-গ-৬০৩। অপরটির কোনো নম্বর প্লেটও নেই।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, এ ধরনের গাড়িগুলো নিবন্ধনবিহীন। এগুলোর নম্বর প্লেটও ভুয়া। নিবন্ধন থাকলে ফিটনেসের বিষয় আসত। মূলত ফিটনেস চলে যাওয়া পুরোনো গাড়ি নিলামে যখন বিক্রি হয়, তখন এসব গাড়ি কিনে নেন একধরনের ব্যবসায়ী। পরে কিছুটা কাজ করে সেগুলো চলাচলের উপযোগী করে লট নম্বর দিয়ে রাস্তায় নামান।

রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দুর্গম এলাকায় অন্য কোনো যানবাহন না থাকার সুযোগে এসব গাড়ি চলে। লোকজন পরিবহন করে থাকে। কিছু করার নেই। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটির মালিক ও চালকের লাইসেন্স সম্পর্কে কিছু এখনো জানা যায়নি।

বান্দরবান বিআরটিএ সূত্র জানায়, বান্দরবানে চলাচল করা মাত্র ৯টি ট্রাকের নিবন্ধন করা রয়েছে। তবে কিছু ট্রাক বাইরের নিবন্ধিত থাকতে পারে। কিন্তু নিবন্ধনের বাইরে এ রকম নিলামের গাড়ি শত শত চলাচল করছে বলে পরিবহন সমিতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তিন চাকার মাহেন্দ্র টেম্পো নিবন্ধিত রয়েছে ৭০টি। অথচ এ ধরনের প্রায় ৫০০ গাড়ি চলছে। এগুলো প্রতিদিন পর্যটক নিয়ে থানচিসহ বিভিন্ন স্থানে যায়। এ ছাড়া তিন চাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধিত রয়েছে ২৭২টি। পুরো বান্দরবানে এ ধরনের অটোরিকশার সংখ্যা হাজারের কম নয়। এদিকে বাস নিবন্ধিত রয়েছে দুটি। নিবন্ধিত পিকআপের সংখ্যা ১৯। অবশ্য বেশির ভাগ বাস ও পিকআপ চট্টগ্রাম থেকে নিবন্ধিত হয়ে আসে বলে বিআরটিএ জানায়।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবহনমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়মিত অভিযান হয় না বলে এ ধরনের লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি চলাচল করছে।

এ ব্যাপারে বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শক মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বান্দরবান অনেক বড় এলাকা। পরিদর্শক আমি একজন। জনবলসংকট আছে। তবু আমরা নিয়মিত অভিযান করি।’

এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ফিটনেসবিহীন ও অনিবন্ধিত গাড়ি কোনোভাবেই চলা উচিত নয়। পাহাড়ে তো নয়ই। তা ছাড়া চালকের লাইসেন্স নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়গুলো বান্দরবানের প্রশাসন নিশ্চিত না করলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না।