একুশের কাছে সংস্কৃতির ঋণ

সৈয়দ আজিজুল হক

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা যে ভাষা আন্দোলন করেছিলাম, সে উপলক্ষ ধরে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসকেই এখন ভাষার মাস হিসেবে পালন করি। পুরো মাসেই চলে বইমেলা, চলে নানা অনুষ্ঠান। তাৎপর্যপূর্ণ এই মাসের শুরুর দিনটিতেই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি একুশের সেই অমর শহীদদের, যাঁরা পুরো জাতির সামনে দেশপ্রেম, মাতৃভাষাপ্রেম এবং ত্যাগ ও সাহসিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন।

সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, ১৯৪৭ সালে একটি নতুন দেশ সৃষ্টি হতে না হতেই আরেকটি নতুন চেতনার জাগরণ ঘটল। প্রথমে এর উন্মেষ ঘটল বুদ্ধিজীবী-চিন্তাবিদ পর্যায়ে, তারপর প্রসারিত হলো সচেতন ছাত্র-যুবক-রাজনৈতিক গণ্ডিতে এবং সবশেষে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল একেবারে সাধারণের স্তরে। বিস্তৃত হলো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত।

নতুন রাষ্ট্রের চেতনা আর এই বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাসহ রাষ্ট্রভাষাকেন্দ্রিক চেতনা অনেকের কাছে ভিন্নধর্মী, কিংবা কারও কারও কাছে সাংঘর্ষিক মনে হলেও এর মধ্যকার গভীর পারম্পর্যের সূত্রটি খুঁজে পাওয়াও মোটেই দুষ্কর নয়। সর্বভারতীয় রাষ্ট্রাদর্শ থেকে পৃথক হয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রাদর্শ গঠনের চিন্তা চল্লিশের দশকের শুরু থেকে ক্রমেই প্রবলতা অর্জন করেছিল। তার মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্যচেতনা ছিল, তা কারও কারও মধ্যে বিরূপতা সৃষ্টি করেছিল। এই বিরূপতার পথ ধরে দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর কলঙ্ক আরোপ করে তারা ধর্মের প্রেরণাকেই মুখ্য করে তুলে অপপ্রচারে পরিতুষ্টি খুঁজেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুল নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রাদর্শের চেতনার মধ্যে যে ধর্মের বিষয়টি মুখ্য ছিল না, ভিন্নতর মুক্তির প্রেরণাই বিশেষভাবে কার্যকর ছিল, সেটা তাদের চোখে পড়েনি, আজও পড়ছে না। ভাষা আন্দোলন সেই মুক্তির বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তুলেছিল।

ভাষা আন্দোলন ছিল দ্বিজাতিতাত্ত্বিক প্রচারণা বা অপপ্রচারণার বিরুদ্ধে এক মোক্ষম প্রতিবাদ। ১৯৪৭ সালের আগস্টে আমরা বাংলার পূর্ব অংশের যে ভূখণ্ডটি পেলাম, তার অন্তর্ভুক্ত জনসমষ্টির কাছে ধর্ম বা দ্বিজাতিতত্ত্ব যে প্রধান ছিল না, তা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়ে গেল। কেননা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই জনগোষ্ঠীর কাছে মাতৃভাষা বাংলাই হয়ে উঠল প্রধান, নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের চিন্তাই হয়ে উঠল মুখ্য। আসলে চল্লিশের দশকে ভারতীয় রাষ্ট্রাদর্শ থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ওই অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টিই প্রধান ছিল বলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রসঙ্গটি এত দ্রুত জনদাবিতে পরিণত হতে পেরেছিল; ধর্মের বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়েছিল।

ভাষা আন্দোলনের একটি বড় শক্তির দিক হলো, এর মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। এই চেতনাকে ভারত ও পাকিস্তান—এই দুই দেশের কেউই স্পর্শ করতে পারেনি। আরও স্পষ্ট করে বললে, পুরো ভারতবর্ষের এই সর্বপূর্ব অংশই কেবল ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক চেতনা দিয়ে তাদের জাতীয়তাবোধকে পরিপুষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যার পূর্ণ প্রকাশ সম্ভবপর হয়েছিল।

একই সঙ্গে এ কথাও স্মরণীয় যে একুশেকে কেন্দ্র করে ভাষা আন্দোলন এমন এক ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, যার তুলনাও এই উপমহাদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সর্বপ্রকার শিক্ষালয়সহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা এবং সেখানে একুশের ভোরে প্রভাতফেরিসহ নগ্নপদে পুষ্পমাল্য অর্পণের যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত পবিত্রমান্য প্রথাটি প্রচলিত হয়েছে, তা-ও এই উপমহাদেশীয় পরিমণ্ডলে এক বিরল ব্যতিক্রমী সেক্যুলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সর্ববৃহৎ ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক আয়োজন হিসেবেও এটি বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করেছে।

শুধু একটি বিশাল কর্মযজ্ঞসহ সাংস্কৃতিক প্রথার উদ্ভাবন নয়, বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রকে প্রবল ও নতুনভাবে উজ্জীবিত করেছে ভাষা আন্দোলন। উজ্জীবনের ওই শক্তিময় ব্যাপকতাকে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গীয় রেনেসাঁ বলেও অভিহিত করা যায়। বড় কথা হলো, ভাষা আন্দোলন ঢাকাকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি নতুন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। ১৯৪৭-উত্তরকালে ঢাকাকে কেন্দ্র করে উৎসারিত যে চিত্রশিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নতুন প্রাণময় ও পূর্ণতর জীবনমুখী ধারা ক্রমাগতভাবে কলকাতাকেন্দ্রিক ধারাকে ম্লান করে তুলেছে, তারও উত্সবিন্দু নিশ্চিতভাবে এই ভাষা আন্দোলন। তাই ভাষা আন্দোলনের কাছে এই জাতির ঋণ অপরিসীম। ভাষার মাসের শুরুতে এই অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

সেই সঙ্গে এ কথাও স্মরণ করছি যে ভাষা আন্দোলনের তাত্পর্য ও একুশের আয়োজনাবলি ক্রমেই আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি একেবারেই গুরুত্ব হারিয়েছে। শক্তিশালী নানা কেন্দ্রের কাছে বাংলা ভাষা এখন বিপুল অবজ্ঞার শিকার। মাতৃভাষা প্রেম এখন একটি গুরুত্বহীন বুলিমাত্র; বরং ইংরেজি-হিন্দি-আরবির দাপট সর্বগ্রাসী। জ্ঞানচর্চাকে অবাধ করে তুলতে হলে একটি শক্তিশালী বিদেশি ভাষা শেখার বিকল্প নেই সত্য; কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা অমার্জনীয়। ফলে মাতৃভাষার মর্যাদাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আরেকটি ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।