এ উপন্যাসের গুরুত্ব কোথায়

ভাষা আন্দোলনের ঘটনা নানাভাবে উদ্দীপ্ত করেছে মানুষকে। এর গভীর প্রভাব পড়েছে পরবর্তী ইতিহাসে। এই আন্দোলনের আবেগ স্ফুরিত হয়েছে সাহিত্যে, গানে, চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে। কবিতা ও কথাসাহিত্য থেকে গবেষণা পর্যন্ত পৌঁছেছে এর প্রেরণা। এখানে রইল ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত একটি বইয়ের আলোচনা।

‘জহির রায়হান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক, যার উদ্ভবের পেছনে আছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন...। যদি বায়ান্নর একুশ না ঘটত তবে জহির রায়হান হয়তো কথাশিল্পী হতেন না।’ এই বক্তব্য হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘একুশের চেতনা ও তিন দশকের উপন্যাস’ প্রবন্ধে পেশ করেছেন। কথাটি সব দিক থেকে সত্য। চলচ্চিত্রের লোক হিসেবেই জহিরের আত্মপ্রকাশ। উপন্যাস লিখেছেন আরেকটু পরে। কিন্তু কথা ওইটাই সত্য, যেটা আজাদ বলেছেন, বায়ান্ন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন আর পঞ্চাশের দশক থেকেই জমে ওঠা ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তা তাঁর সাহিত্যের বড় অবলম্বন। সহায় হয়েছে সেই সময়কার দেশ-সমাজের ভেতরে ঘটে যাওয়া নানা বিষয়। তার ভেতরেই নিশ্বাস নিয়েছেন জহির। দেখেছেন। শুনেছেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবীজ বপন করেছেন নিজের চেতনায়। তা থেকে রাজনৈতিকতা উৎপাদিত হয়েছে। যদিও তা ছিল বহুবর্ণিল। আর এ প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে এসেছে সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিষয়। যদিও এই উপজাতের দরকার সেই সময়ে কোনো অংশে কম ছিল না; দরকারি হয়েছে পরবর্তী সময়েও।

আরেক ফাল্গুন

জহির রায়হান

সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা; প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯

অত্যন্ত সচেতনভাবে, পূর্বোক্ত প্রক্রিয়ার ভেতরে সক্রিয় থেকে, জহিরের প্রথম প্রচেষ্টা এই আরেক ফাল্গুন। সফল তিনি। পূর্ব-বাংলায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে জহিরই প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রচনা করলেন; ভাষা আন্দোলন শেষ হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর। কিন্তু এত দেরি হলো কেন? আরেক ফাল্গুন-এর কাহিনি কিন্তু ’৪৮ কিংবা ’৫২-এর বাস্তবতায় লেখা নয়। এই উপন্যাসের কাহিনি ১৯৫৫ সালের। ১৯৫৫ সালের ঘটনাবহুল বাস্তবতায় জহিরের নিজের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক জীবনের বাস্তবতার আলেখ্য এ উপন্যাস। কিন্তু পেছনে চাপটা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের। এর সঙ্গে জহির কেবল একাই জড়িত নন। সম্পৃক্ত হচ্ছে সমগ্র জনগোষ্ঠী। মাত্র কয়েক দিনের ঘটনা নিয়ে এ উপন্যাস রচিত হয়েছে। কাহিনিও অত্যন্ত সরল। ভাষা আন্দোলন ও তার পরবর্তী বছর দশেকজুড়ে যে রাজনৈতিক ঘটনাবলি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সংঘটিত হচ্ছিল, তারই একটি পশলা নিয়ে লেখা হয়েছে এ উপন্যাস।

এ উপন্যাস তাহলে আমরা কেন পড়ব? কেন সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিবেচনায় বিবেচিত হবে এই উপন্যাস? কেন রাজনৈতিক উপন্যাসের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে এই উপন্যাস?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার উপন্যাস পাঠ করলে এ বিষয় আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়, পূর্ব বাংলার উপন্যাসের বিষয় কেবলই ‘গাঁওগেরামের কাহিনি’। ‘লিটারারি রেটোরিকে’ তার গুরুত্ব যা–ই হোক না কেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এর ভালো প্রতিনিধি। একটু মনোযোগ দিলে দেখা যাবে, উপন্যাস বাদ দিয়ে তাঁর অন্য সাহিত্যকর্মের বিষয় তা-ই। বহু বছর পর্যন্ত আমাদের উপন্যাস এ বিষয় থেকে বের হতে পারেনি। উদাহরণ, আশির দশকে লেখা আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ। আবুল মনসুর আহমদ কিংবা আবু জাফর শামসুদ্দীন, এমনকি আলাউদ্দিন আল আজাদও যেন কেন্দ্রে থেকেও প্রান্তের জয়গান গাইতে চেয়েছেন। জহির রায়হান নিজেও যে তা করেননি, তা নয়। হাজার বছর ধরে তার ভালো উদাহরণ। কিন্তু কিছুদিন পরই তিনি ফিরে এলেন প্রদেশের রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে। একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রক্রিয়া-প্রবণতায় মিশে গেলেন। এ নিয়ে তিনি লিখলেন।

আমরা পূর্বে পঞ্চাশ ও ষাটের উত্তাল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উপজাত হিসাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বুঝিয়েছিলাম। উত্তাল সেই পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের কোনোভাবেই অরাজনৈতিক হতে দেয়নি। এই উপজাতের একটা বড় ভূমিকা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। আরেক ফাল্গুন উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে সেই যাত্রার সূচনা; যেখান থেকে, পরবর্তী সময়ে, ধারাটি বিপুলতায় ফুলে–ফেঁপে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে আরেক ফাল্গুন-এর ভূমিকা বিরাট।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক উপন্যাসচর্চায় জহির রায়হানের এই উপন্যাসের বড় ভূমিকা আছে। তিনি নিজে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি করেছেন। কিন্তু লড়াইটা করছেন গণতন্ত্রের জন্য। যদিও গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রকে নানা সময় নিন্দা করেছেন তাঁর নিজের রাজনৈতিক আদর্শের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে। আবার ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে নতুন রাজনীতিতে সক্রিয় করে তুলেছিল। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাগুলো নিয়ে সাহিত্য করার যে ধারা তৈরি হলো, তার সূচনা বলতে গেলে আরেক ফাল্গুন। পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশের উপন্যাস পাঠের ক্ষেত্রে এ উপন্যাস তাই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক।